Saturday, June 9, 2012

চতুরঙ্গ - (শেষ পর্ব) [Ghost Stories - p- last ]


চতুরঙ্গ -(শেষ পর্ব)
লেখক:নিথর শ্রাবণ শিহাব


[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]

সমস্ত বাড়ির জিনিস পত্রগুলো মাটি থেকে দু তিন হাত
ওপরে উঠে যাচ্ছে, আবার নেমে বসে যাচ্ছে...... আমার
ভয়টা ছড়িয়ে পরছে দ্রুত সারা শরীরে.....
ওপরে ছাদের দাবা বোর্ডের অতিপ্রাকৃত
খেলাটা আমার ভেতরে আতংকের
সৃষ্টি করছে ক্রমশ......তার থেকেও ভয়ংকর ব্যপার হল
হল রুমের অল্প আলোতে দেখা যাচ্ছে শাড়ি পরা,
মাথায় স্কার্ফ দেয়া একজন মহিলা এলোমেলো জিনিস
পত্রগুলোকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছেন..... জয়নাব
আরা!
আমি অস্বাভাবিক রকম আতংকিত হয়ে পাগলের মত
দৌড়াতে লাগলাম। মিউজিয়ামের পরিধি যেন
বাড়ছেই..... পথ আর শেষ হচ্ছে না......
লনের সব গ্রীক
দেবতা মূর্তিগুলো সে রাতে মাটি থেকে দু তিন
তলা উঁচুতে ভাসছিল লনের ওপর- আমি যখন
পালাচ্ছিলাম.......







০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
সেদিনের পর আমি ডাঃ এমরানের মিউজিয়ামের
চাকরি ছেড়ে দেই। বলা বাহুল্য ডাঃ এমরানের সঙ্গেও
আর দেখা করিনি। আমি সুস্থ থাকতে চাই। পাগল
হয়ে মরতে চাই না। আমার ধারণা ওই বাড়ির
বাকি তিন জন মানুষ ডাঃ এমরানের এই
অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে জানে। নইলে কখনই
তাদেরকে কাছে পাই নি কেন?
আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসার অনেক দিন পর
আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন ডাঃ এমরান।
তিনি হাসপাতালে ভর্তি তখন। খুব অসুস্থ।
মেরুদন্ডে ভর রাখতে পারেন না এখন আর।
শুয়ে শুয়ে থাকতে হয় তাঁকে। এসব ফোনে জেনেছিলাম
নার্গিসের কাছ থেকে। দেখা করতে যাইনি।
ডাঃ এমরান এক পৃষ্ঠায় কাঁপা হাতে পেন্সিল
দিয়ে চিঠি লেখেছিলেন। শুয়ে থেকে কলম
দিয়ে লিখতে পারেননি।
মা নোভেরা, জানি হয়ত এ বুড়োর ওপর তোমার
অভিমান কিংবা ভয় এ জীবনে যাবে না। তবুও
বলি জয়নাবকে হারানোর এতবছরের
বন্দী জীবনে তুমি ছাড়া কেউ আমার কাছে কখনো জেদ
ধরে বাচ্চাদের মত কেঁদে ফেলত না।কখনো কেউ
জিজ্ঞেস করত না শুঁকিয়ে এ কি অবস্থা করেছেন
শরীরের?’ তুমি যখন জিজ্ঞেস করতে বড় মায়া লাগত।
খুব কষ্টে চোখের পানি আড়াল করতাম। কাঠ
খোট্টা মানুষের চোখে পানি মানায় না। তোমার
সাথে জয়নাবের একটা মিল ছিল- সে যখন তখন আমার
সাথে কথা বলার জন্য টুল টেনে বসে পড়ত।
সেখানে চেয়ার থাকলেও টুলেই বসত।
সারা বাড়িতে টুল আর টুল ছড়িয়ে রেখেছিল সে। অবাক
লাগছে? এই বুড়ো এত কিছু খেয়াল করত? হাঃ হাঃ!
তাহলেই বোঝ, আমি কতটা চুপচাপ একা একা সময়
কাটাতাম যে তোমাকে এতটা লহ্ম্য করার সময়
পেয়েছি। ব্যস্ত হবার জন্য বোধ হয় মিল খোঁজাই ছিল
আমার এক মাত্র কাজ।আমি জানি আমাকে তুমি ভয়
না পেলেও আমার চারপাশটাকে খুব ভয় পাও। কিন্তু
ভয়ের কিছু নেই। আজ যা রহস্য- কাল
তা সাধারণে পরিণত হবে। তুমি জাহিদ বিষয়ক
একটা দোটানায় আছো জানি। তাই তোমাকে বলি।
আমরা বিভক্ত। আমাদের আরো অস্তিত্ব রয়েছে। অনেক
তুমিআছো, অনেক আমিআছি, অনেক আমরাআছে।
তুমি এগুলোকে যতই অস্বীকার করো না কেন,
এড়াতে পারবে না। তাই এদের নিয়েই বসবাস
করতে হয় আমাদের। কারণ এরাও ভালবাসার কাঙ্গাল।
অনেক স্নেহ আর ভালবাসা রেখে গেলাম তোমার জন্য।
কে জানে এই অনেকেরমাঝে নিশ্চই কোথাও
না কোথাও তুমি আমার সন্তান ছিলে। নইলে এতটা কষ্ট
লাগে কেন? -ডাঃ এমরান চৌধুরী
চিঠি পাওয়ার তিন মাস পর মারা যান ডাঃ এমরান।
আমি দেখা করতে যাইনি তখনো। কেবল
একা একা কাঁদতাম। আমার দেখা পৃথিবীর সব
চেয়ে ভাল মানুষটা মারা যাবার সময়
আমাকে কাছে পাননি।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
জাহিদের সঙ্গে আমার বিয়েটা হল আরো এক বছর পর। ও
তখন একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চিফ
ইঞ্জিনিয়ার পদে কাজ করছে।
রাতে জাহিদকে প্রায়ই বলি, “ তোমার সেই পথের
শেষকবিতাটা শোনাবে?”
হঠাৎ?” খুশি খুশি গলায় বলে ও।
কটন বার্ডের প্যাকেটটা খুঁজে পাচ্ছি না।
কানে ময়লা হয়েছে। পরিষ্কার করা দরকার। তোমার
কবিতার মূল্য পাবলিক বুঝলে এতদিনে কটন বার্ডের
কোম্পানিগুলো উঠে গিয়ে তোমার কবিতার ক্যাসেট
বের করত।
অ!হতাশ গলায় বলে জাহিদ।
কি হল? বল?”
ও!গলা খাকারি দেয় জাহিদ, বলা শুরু করে-
কতই শত টানা পোড়েন
নিত্য এ সংসার,
অশ্রু জলে সাজিয়ে তুমি
হারিয়ে যাবে আর?
একাই অনেক পথ হেটে আজ
হাত বাড়ালাম তাই,
পথের শুরুয় পাইনি তো কি?
পথের শেষে চাই।
কবিতাটা তো অন্য রকম ছিল! শেষের লাইন
দুটো বাদে।অবাক হয়ে বলি।
মাথা চুলকায় জাহিদ, “ অ! তাই নাকি?
ভুলে গেছি আগের লাইনগুলো। শেষের লাইন
দুটো মনে থাকে কেবল।
অসুবিধা নেই। প্রত্যেক রাতে নতুন নতুন লাইন
বানিও তুমি, কেবল শেষের লাইন দুটো ঠিক রেখো।
কেন? শেষের লাইন দুটো বেশি ভাল?”
নাহ। ও দুটো শুনলে মনে হয় কানের
পোঁকা বেরিয়ে গেল। তাই।হেসে ওর
চুলগুলো এলোমেলো করে দেই। জাহিদও হাসতে থাকে।
ঠিক এই সময়েই পাশের দোলনা থেকে আমাদের
বাবুটা ওয়া ওয়াশুরু করে দেয়। বলিনি তো, আমার
একটা বাবু হয়েছে। ছয় মাস বয়স। নাম
রেখেছি বাবাই। ভাল নামটা বলবো না। বাবুদের
বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত ডাক নামেই ভাল শোনায়। বড়
নাম বললে মনে হয় বড় বড় মানুষ!বাবাই ওয়া ওয়া শুরু
করলে জাহিদ কৃত্রিম বিরক্তি নিয়ে বলে, “ ওহহো রে!
মাম্মি- ডেডির রোমান্সের মাঝখানে ওয়া ওয়া
ব্যাক গ্রাউন্ড মিউজিক ক্যান? তোমার ছেলে তো বড়
হলে ডি.জে. হবে দেখছি!
তখন উঠে লাইট জ্বালিয়ে গিয়ে দেখি বাবাই
মহা আনন্দে একটা নতুন দাবার ঘুটি নিয়ে খেলছে।
ফোকলা মাড়ি দিয়ে সেটাকে কামড়াচ্ছে। আমাদের
বাবাই প্রতি রাতে একটা করে দাবার ঘুটি পায়।
আমি জানি কে দেয়। খুব যত্ন
করে সেগুলোকে জমিয়ে রাখি আমি। আমাদের বাবাই বড়
হলে দাবা খেলবে। আমি জানি, কেউ
ওকে হারাতে পারবে না। অন্তত বাবাইয়ের
দ্বিগ্বীজয়ী ফোকলা হাসিটা সেটাই বলে দেয়!
(সমাপ্ত)

রাজসাক্ষী [ghost stories - 145]


****রাজসাক্ষী ***

অতনুর পুরো নাম শিহাব শাহিন অতনু, ওর নানার রাখা নাম। ওদের বাড়ি উত্তর বঙ্গে, বর্ডারের কাছে। জায়গাটা ভয়াবহ রকমের দুর্গম। ইলেক্ট্রিসিটি তো দূরের কথা, একটা খাম্বাও নেই। যাতায়াতের মাধ্যম পায়ে হাঁটা পথ। প্রায় ১০মাইল হাঁটলে পাকা রাস্তা পাওয়া যায়। অতনুর এই অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম হলেও ওর আধুনিক নামই বলে দেয় ওদের পরিবার গ্রামের আর ১০টা পরিবার থেকে আলাদা। ছোটবেলা বাবা মারা যাওয়ার পর নানা বাড়িতেই 
...বেড়ে ওঠে। ওর নানারা ওপারের লোক, যুদ্ধের পর এপারে চলে আসে। পরিবারের নামটাই যা ছিল, এছাড়া একেবারে নিঃস্ব হয়ে এপারে আসতে হয়। ও আবছা ভাবে জানে যে নানারা নাকি শুদ্ধ ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরে ধর্মান্তরিত হয়েছেন।

ওর পরিবারে ৩টা আজব ঘটনা ঘটেছে। ওর বড় মামা, মেজ খালু আর মেজ নানা তিনজনই খুন হন। বর্ডার এলাকায় এসব স্বাভাবিক ঘটনা, তাই কোন থানা পুলিশ হয়নি। লাশ পাওয়ার পর ২-৪ দিন চোখের পানি ফেলে আবার কাজে মন দিয়েছে সবাই। এইসব ঘটনা যখন ঘটে তখন ওর বয়স ১১, আজ থেকে ১৭ বছর আগের কথা। তারপর ও বড় হয়ে এখন ঢাকায় থাকে। তিন দিন হল গ্রামে এসেছে শেষ যেটুকু ভিটামাটি ছিল তা বেঁচে দিতে।

শনিবার রাত। গ্রামে এখন এক ছোট মামা ছাড়া আর কেউ থাকে না। বিশ রুমের একটা টিনশেড দোতলা বাড়ি পুরো ফাঁকা পড়ে থাকে। ও উপরের ঘরটা নিলো। রাতে বেশ চাঁদ দেখতে দেখতে ঘুমানো যাবে। গ্রামে কতদিন রাত কাটানো হয়না।

রাত তিনটায় একটু টয়লেট পেলো ওর। এখানের একটা সমস্যা হচ্ছে টয়লেট করতে নিচে নামতে হয়। কি আর করা, নেমে টয়লেট সারলো। কলপাড়ে এসে হাত ধুতে যাবে, দেখল দুজন লোক বসে আছে নিচতলার বারান্দায়। কিছু নিয়ে তর্কাতর্কি হচ্ছে ওদের মধ্যে বোঝা গেল। খেয়াল করলো টর্চ আনতে ভুলে গেছে ও। কিন্তু এত রাতে এখানে বসে ঝগড়া করছে কারা? ভালমত তাকালো, দেখলো একটা লোক উঠে দাঁড়িয়েছে। তীব্র রেগে গেছে সে, আচমকা একটা ছুরি বের করে আমুল বসিয়ে দিল সে অপর লোকটার বুকে। পিচ করে একটা শব্দ হল। আঁতকে উঠল ও, খুন!! দ্রুত লুকানোর জায়গা খুঁজল ও, পেলোনা। ওদিকে লোকটা এদিকেই এগিয়ে আসছে। মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ও। কিন্তু লোকটা ওর চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল, ওর দিকে তাকালও না। লোকটা একটু দূরে ডোবার ধারে গেলে চাঁদের আলো পড়লো লাশটার মুখে। চাঁদের আলোয় চিনতে কোন সমস্যা হলনা। বড় মামা!! লাশটা আর কারো না, বড় মামার!!
সারা গা ঝিমঝিম করে উঠল ওর। দ্রুত ছুটল বাম পাশের ঝোপের দিকে, ওখানে বড় মামার কবর আছে। গিয়ে যা দেখল তা এক কথায় অবিশ্বাস্য।
কবরটা খোঁড়া, চারিদিকে মাটি ছড়িয়ে আছে, একটা রক্ত মাখা ইট পড়ে আছে পাশে!!
গ্রামের লোকদের ডাকে জ্ঞান ফেরে অতনুর। কবরের পাশে পড়ে আছে ও। চারিদিকে অনেক লোকজন, এক এক জনের এক এক জিজ্ঞাসা। তার মাঝেই কবরের দিকে তাকাল ও, সব সুস্থ, স্বাভাবিক, শান্ত। কবরের মাটি দেখে সহজেই বোঝা যায় গত ১৭ বছরে কেউ তা খোঁড়েনি। তবে কি দুঃস্বপ্ন দেখছিল ও? তাই হবে হয়ত। ধীরে ধীরে লোকের কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল ও, তখুনি চোখ আটকাল একটা ইটের দিকে। গোল, একপাশে রক্ত মাখা। বুকটা ছাঁৎ করে উঠল ওর! ঠিক তখুনি, একটু গড়িয়ে পাশের ডোবাটায় পড়ে গেলো সেটা।

এই ঘটনার ২ ঘণ্টা পরেই বাসে করে ঢাকায় চলে আসে ও। কাউকে কিছু জানায় না। সবকিছু একটা দুঃস্বপ্ন বলে ভেবে নেয়।
দুই দিন পর। বাসায় কেউ নেই। একা ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিল ও, এমন সময় কারেন্ট চলে গেলো। মোম জ্বালাতে রান্নাঘরে যায় ও, আইপিএস টাও আবার নষ্ট।
ফিরে এসে দেখে ড্রয়িংরুম ভর্তি ৬-৭ জন লোক। সবার মুখে লাল কাপড় বাঁধা। একটা লোককে বেঁধে রেখেছে তারা। মোমের আলোয় চিনতে কষ্ট হয়না, ওটা মেজ খালু!!!
হটাৎ লোকগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে খালুর উপর। মুহূর্তে টুকরো টুকরো করে ফেলে ছুরি দিয়ে। শুধু ধড় আর মাথাটা রেখে বাকি হাত,পা আলাদা হয়ে যায়। এক ফোঁটা রক্ত ছিটে এসে লাগে ওর শার্টে। ওখানেই জ্ঞান হারায় ও।
জ্ঞান ফেরে পরদিন হসপিটালে। ঘরে ফেরার পর দেখে সব ঠিক আছে, তবে তার শার্টে রক্তের দাগ লাগলো কিভাবে, স্ত্রীর এই প্রশ্নের জবাব সে দিতে পারলনা।

চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন একটা মানুষিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ও। তীব্র কঠিন ওষুধ খেয়ে স্রেফ বেঁচে আছে। দুটি মৃত্যু ঘটনার রাজসাক্ষী হয়ে, তৃতীয় ঘটনাটি ঘটার অপেক্ষায়।

শেয়ার করেছেনঃ
Kallîum Cyanîde Pîxel