চতুরঙ্গ -(শেষ পর্ব)
লেখক:নিথর শ্রাবণ শিহাব
[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]
[ বিঃদ্রঃ বাকী পর্বের লিঙ্ক এই পর্বের শেষে দেওয়া আছে ]
সমস্ত বাড়ির জিনিস
পত্রগুলো মাটি থেকে দু তিন হাত
ওপরে উঠে যাচ্ছে, আবার
নেমে বসে যাচ্ছে...... আমার
ভয়টা ছড়িয়ে পরছে দ্রুত
সারা শরীরে.....
ওপরে ছাদের দাবা বোর্ডের
অতিপ্রাকৃত
খেলাটা আমার ভেতরে
আতংকের
সৃষ্টি করছে
ক্রমশ......তার থেকেও ভয়ংকর ব্যপার হল
হল রুমের অল্প আলোতে
দেখা যাচ্ছে শাড়ি পরা,
মাথায় স্কার্ফ দেয়া একজন
মহিলা এলোমেলো জিনিস
পত্রগুলোকে সুন্দর করে
সাজিয়ে রাখছেন..... জয়নাব
আরা!
আমি অস্বাভাবিক রকম
আতংকিত হয়ে পাগলের মত
দৌড়াতে লাগলাম।
মিউজিয়ামের পরিধি যেন
বাড়ছেই..... পথ আর শেষ
হচ্ছে না......
লনের সব গ্রীক
দেবতা মূর্তিগুলো সে
রাতে মাটি থেকে দু তিন
তলা উঁচুতে ভাসছিল লনের
ওপর- আমি যখন
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
সেদিনের পর আমি ডাঃ
এমরানের মিউজিয়ামের
চাকরি ছেড়ে দেই। বলা
বাহুল্য ডাঃ এমরানের সঙ্গেও
আর দেখা করিনি। আমি
সুস্থ থাকতে চাই। পাগল
হয়ে মরতে চাই না। আমার
ধারণা ওই বাড়ির
বাকি তিন জন মানুষ ডাঃ
এমরানের এই
অস্বাভাবিকতা সম্পর্কে
জানে। নইলে কখনই
তাদেরকে কাছে পাই নি কেন?
আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসার
অনেক দিন পর
আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন
ডাঃ এমরান।
তিনি হাসপাতালে ভর্তি
তখন। খুব অসুস্থ।
মেরুদন্ডে ভর রাখতে
পারেন না এখন আর।
শুয়ে শুয়ে থাকতে হয়
তাঁকে। এসব ফোনে জেনেছিলাম
নার্গিসের কাছ থেকে।
দেখা করতে যাইনি।
ডাঃ এমরান এক পৃষ্ঠায়
কাঁপা হাতে পেন্সিল
দিয়ে চিঠি লেখেছিলেন।
শুয়ে থেকে কলম
দিয়ে লিখতে পারেননি।
“ মা নোভেরা, জানি
হয়ত এ বুড়োর ওপর তোমার
অভিমান কিংবা ভয় এ জীবনে
যাবে না। তবুও
বলি জয়নাবকে হারানোর
এতবছরের
বন্দী জীবনে তুমি ছাড়া
কেউ আমার কাছে কখনো জেদ
ধরে বাচ্চাদের মত কেঁদে
ফেলত না।কখনো কেউ
জিজ্ঞেস করত না ‘শুঁকিয়ে
এ কি অবস্থা করেছেন
শরীরের?’ তুমি
যখন জিজ্ঞেস করতে বড় মায়া লাগত।
খুব কষ্টে চোখের পানি
আড়াল করতাম। কাঠ
খোট্টা মানুষের চোখে
পানি মানায় না। তোমার
সাথে জয়নাবের একটা মিল
ছিল- সে যখন তখন আমার
সাথে কথা বলার জন্য টুল
টেনে বসে পড়ত।
সেখানে চেয়ার থাকলেও
টুলেই বসত।
সারা বাড়িতে টুল আর টুল
ছড়িয়ে রেখেছিল সে। অবাক
লাগছে? এই
বুড়ো এত কিছু খেয়াল করত?
হাঃ হাঃ!
তাহলেই বোঝ, আমি
কতটা চুপচাপ একা একা সময়
কাটাতাম যে তোমাকে এতটা
লহ্ম্য করার সময়
পেয়েছি। ব্যস্ত হবার
জন্য বোধ হয় মিল খোঁজাই ছিল
আমার এক মাত্র কাজ।আমি
জানি আমাকে তুমি ভয়
না পেলেও আমার
চারপাশটাকে খুব ভয় পাও। কিন্তু
ভয়ের কিছু নেই। আজ যা
রহস্য- কাল
তা সাধারণে পরিণত হবে।
তুমি জাহিদ বিষয়ক
একটা দোটানায় আছো জানি।
তাই তোমাকে বলি।
আমরা বিভক্ত। আমাদের আরো
অস্তিত্ব রয়েছে। অনেক
‘তুমি’ আছো, অনেক ‘আমি’ আছি, অনেক ‘আমরা’ আছে।
তুমি এগুলোকে যতই
অস্বীকার করো না কেন,
এড়াতে পারবে না। তাই
এদের নিয়েই বসবাস
করতে হয় আমাদের। কারণ
এরাও ভালবাসার কাঙ্গাল।
অনেক স্নেহ আর ভালবাসা
রেখে গেলাম তোমার জন্য।
কে জানে এই ‘অনেকের’ মাঝে
নিশ্চই কোথাও
না কোথাও তুমি আমার
সন্তান ছিলে। নইলে এতটা কষ্ট
লাগে কেন? -ডাঃ
এমরান চৌধুরী”
চিঠি পাওয়ার তিন মাস পর
মারা যান ডাঃ এমরান।
আমি দেখা করতে যাইনি
তখনো। কেবল
একা একা কাঁদতাম। আমার দেখা
পৃথিবীর সব
চেয়ে ভাল মানুষটা মারা
যাবার সময়
আমাকে কাছে পাননি।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
জাহিদের সঙ্গে আমার
বিয়েটা হল আরো এক বছর পর। ও
তখন একটা মাল্টি
ন্যাশনাল কোম্পানিতে চিফ
ইঞ্জিনিয়ার পদে কাজ
করছে।
রাতে জাহিদকে প্রায়ই বলি, “ তোমার
সেই ‘পথের
শেষ’ কবিতাটা
শোনাবে?”
“ হঠাৎ?” খুশি
খুশি গলায় বলে ও।
“ কটন বার্ডের প্যাকেটটা খুঁজে
পাচ্ছি না।
কানে ময়লা হয়েছে।
পরিষ্কার করা দরকার। তোমার
কবিতার মূল্য পাবলিক
বুঝলে এতদিনে কটন বার্ডের
কোম্পানিগুলো উঠে গিয়ে
তোমার কবিতার ক্যাসেট
বের করত।”
“ অ!” হতাশ
গলায় বলে জাহিদ।
“ কি হল? বল?”
“ ও!” গলা
খাকারি দেয় জাহিদ,
বলা শুরু করে-
“ কতই শত টানা পোড়েন
নিত্য এ সংসার,
অশ্রু জলে সাজিয়ে তুমি
হারিয়ে যাবে আর?
একাই অনেক পথ হেটে আজ
হাত বাড়ালাম তাই,
পথের শুরুয় পাইনি তো কি?
পথের শেষে চাই।”
“ কবিতাটা তো অন্য রকম ছিল! শেষের
লাইন
দুটো বাদে।” অবাক
হয়ে বলি।
মাথা চুলকায় জাহিদ, “ অ! তাই
নাকি?
ভুলে গেছি আগের
লাইনগুলো। শেষের লাইন
দু’টো মনে
থাকে কেবল।”
“ অসুবিধা নেই। প্রত্যেক রাতে
নতুন নতুন লাইন
বানিও তুমি, কেবল
শেষের লাইন দুটো ঠিক রেখো।”
“ কেন? শেষের
লাইন দুটো বেশি ভাল?”
“ নাহ। ও দুটো শুনলে মনে হয় কানের
পোঁকা বেরিয়ে গেল। তাই।” হেসে
ওর
চুলগুলো এলোমেলো করে
দেই। জাহিদও হাসতে থাকে।
ঠিক এই সময়েই পাশের
দোলনা থেকে আমাদের
বাবুটা ‘ওয়া
ওয়া’শুরু করে দেয়। বলিনি তো, আমার
একটা বাবু হয়েছে। ছয় মাস
বয়স। নাম
রেখেছি “বাবাই”। ভাল
নামটা বলবো না। বাবুদের
বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত ডাক
নামেই ভাল শোনায়। বড়
নাম বললে মনে হয় বড় বড়
মানুষ!বাবাই ওয়া ওয়া শুরু
করলে জাহিদ কৃত্রিম
বিরক্তি নিয়ে বলে,
“ ওহহো রে!
মাম্মি- ডেডির রোমান্সের
মাঝখানে ‘ওয়া ওয়া’
ব্যাক গ্রাউন্ড মিউজিক
ক্যান? তোমার ছেলে তো বড়
হলে ডি.জে. হবে দেখছি!”
তখন উঠে লাইট জ্বালিয়ে
গিয়ে দেখি বাবাই
মহা আনন্দে একটা নতুন
দাবার ঘুটি নিয়ে খেলছে।
ফোকলা মাড়ি দিয়ে সেটাকে
কামড়াচ্ছে। আমাদের
বাবাই প্রতি রাতে একটা
করে দাবার ঘুটি পায়।
আমি জানি কে দেয়। খুব
যত্ন
করে সেগুলোকে জমিয়ে রাখি
আমি। আমাদের বাবাই বড়
হলে দাবা খেলবে। আমি
জানি, কেউ
ওকে হারাতে পারবে না।
অন্তত বাবাইয়ের
দ্বিগ্বীজয়ী ফোকলা
হাসিটা সেটাই বলে দেয়!
(সমাপ্ত)