Thursday, April 29, 2021

জীবন গঠনের মূলসূত্র

 

জীবন গঠনের মূলসূত্র
শামসুন্নাহার নিজামী

 একমাত্র  মেয়ে। মেয়েটির বিয়ে হয়ে শশুরবাড়ী চলে  গেল। বেশ কিছুদিন পরে সে এলো বাপের বাড়ি। মা জিজ্ঞাসা করল,তুমি কেমন আছো?  মেয়েটির জানালো সে খুব ভালো নেই।  শ্বশুরবাড়িতে তার এডজাস্ট করতে কষ্ট হচ্ছে। ইত্যাদি ইত্যাদি......। বাপের বাড়িতে মেয়েটি আনন্দে হাসিখুশিতে কাটাল। দেখতে দেখতে তার শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাবার সময় ঘনিয়ে এলো। 

একদিন তার মা রান্না  ঘরে  একটি পাত্রে কিছু ডিম,গাজর আর কফি  বিন সিদ্ধ করতে দিলেন । সিদ্ধ হওয়ার পর সে অন্য পাত্রে সেটি ঢেলে রাখলেন। মেয়েটিও মায়ের সাথে রান্না ঘরে ছিল। মা তখন জিজ্ঞাসা করলেন এখান থেকে তুমি কি কিছু বুঝতে পারলে? মেয়েটির জবাব দিল না। স্বাভাবিকভাবেই তুমি এগুলো সিদ্ধ করেছো। 

মা তখন বললেন এখানে ডিম ছিল ভঙ্গুর  ভিতরে  নরম। সিদ্ধ করার কারণে তার শক্ত হয়ে গেছে। গাজর ছিল শক্ত। সিদ্ধ হয়ে সেটা নরম হয়ে গেছে। আর কফি বিন গলে সমস্ত কিছুর সঙ্গে মিশে সুন্দর সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। তিনি বললেন মেয়েরা যখন শ্বশুর বাড়িতে যায় তখন ভিন্ন পরিবেশে তাকে মোকাবেলা করতে হয়। যদি তুমি ডিমের মতো নরম হও তাহলে পরিবেশ তোমাকে শক্ত করে ফেলবে। গাজরের মত শক্ত হলে তোমাকে নরম করে ফেলবে। আর কফি বিনের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারলে সৌরভ ছড়িয়ে পড়বে। শ্বশুরবাড়ি কে নিজের মনে করে  সেখানে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যেই সার্থকতা এবং সুখ। আমার মা আমাকে এইভাবে বুঝিয়েছেন। আমিও তোমাকে সেই শিক্ষাই দিতে চাই। 

এরপর মেয়েটি যখন শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল তখন মা লক্ষ্য করলেন যে মেয়ে খুবই উৎফুল্ল এবং আনন্দের সাথে যাচ্ছে।  বিয়ের পর মেয়েদের কে শ্বশুরবাড়ি নামক এক অজানা পরিবেশে যেতে হয়। সেখানে বউ হিসেবে তার ওপর চাপে অনেক দায়িত্ব কর্তব্যের বোঝা। সে আর তখন তার বাবা মায়ের রাজকন্যা নয়। তাকে সবাই  উৎসুক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে। সামান্যতম   ছাড় দিতেও কেউ রাজি নয়। সেখানে মেয়েটি কি করবে?

 এর প্রাথমিক দায়িত্ব বাবা-মায়ের । সন্তান প্রতিপালনের ব্যাপারে দায়-দায়িত্ব মূলত তাদেরই। ছেলে হোক বা মেয়ে হোক সবাইকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে না পারলে বৃহত্তর  অঙ্গনে তাদেরকে হোঁচট খেতে হয়। এক্ষেত্রে পিতামাতাকে হতে হবে আদর্শ । তাদেরকে অনুকরণ অনুসরণ যোগ্য দৃষ্টান্ত রাখতে হবে। সন্তানদের মন-মগজে ও চরিত্র গঠনের জন্য এটাই কার্যকর মাধ্যম যা তারা সন্তানদের বলবেন তা তাদের নিজের জীবনে থাকতে হবে।

 সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে সূরা লোকমানের দ্বিতীয় রুকুতে বর্ণিত শিক্ষা কে সামনে রাখলে বিশেষভাবে উপকৃত হওয়া যায়। শিক্ষা গুলো হচ্ছে:-
১. সন্তানকে শুরু থেকে শিরক মুক্ত তৌহিদের অনুসারী বানাতে হবে।
২. পিতা মাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৩. নামাজ কায়েমের  তাগিদ দিতে হবে ।
৪. কুরআনে বর্ণিত  দায়ী ইলাল্লাহ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে ।
৫. সৎকাজে আদেশ দান ও অসৎ কাজে বাধা  দানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৬. এ পথে বাঁধা প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলায় ধৈর্যধারণের তাগিদ দিতে হবে।

 কথাবার্তা চালচলন আচার-ব্যবহার যাতে সুন্দর ও মার্জিত হয় সে ব্যাপারে তাগিদ দিতে হবে।  মানুষ যদি তার দায়িত্ব  কর্তব্য পালনে সচেতন হয় তাহলে সঠিক ভাবে তার কাজ করা সম্ভব হয়। সমানে সংসারের পেশাগত জীবনে সবখানেই আমাদের যেমন কিছু দায়-দায়িত্ব রয়েছে তেমনি কর্তব্য ও আছে। এর একক সীমারেখা আছে। সবাই যদি যার যার দায়িত্ব কর্তব্য সঠিক  ভাবে পালন করে। সীমারেখা অতিক্রম না করি তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা না। 
আমাদের কার্যকলাপ কেউ লক্ষ্য করছে অথবা রেকর্ড হচ্ছে জানলে আমরা সবাই সতর্ক থাকি। উন্নত দেশগুলোকে যেখানে CCTV ক্যামেরা থাকে সেখানে সবাই সাবধান হয়ে যায়। এমনকি গাড়ী চালাতে গিয়ে SPREED CONTROL করে। আমরা যদি জীবনের সবকিছু আল্লাহর কাছে RECORD হচ্ছে এই অনুভূতি নিয়ে করি তাহলে আমরা নিজেদেরকে CONTROL করতে পারব। আর তাই শিশুকাল থেকেই শিরক এবং তৌহিদের শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত জরুরী। যা পরবর্তী জীবনে মানুষের জীবনে প্রতিফলিত হয়।ইসলামের ফরজ বিধিবিধান মেনে চলার মধ্যে দিয়ে মানুষের মধ্যে  ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হয়। আচার আচরণ কথা বার্তায় নম্রতা ভদ্রতা সৃষ্টি হয়।

মানুষ সবসময় বাস্তব জীবনে অনুকুল পরিবেশ পাবে। এক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার সাথে সবর এখতিয়ার করতে হবে। সমস্ত কিছুর প্রতিদান আল্লাহর কাছে পাওয়া যাবে এ ভরসা রাখতে হবে।

যে গল্পটা দিয়ে শুরু করছিলাম সেখানে তিনটি জিনিসের মধ্যে কফি বীন সবকিছুর মধ্যে মিশে গিয়েছে। কিন্তু নিজে অস্তিত্বহীন হয়ে যায়নি। সবকিছুর মধ্যে তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে।সৌরভ ছড়িয়েছে। পক্ষান্তরে বেশি নরম বা বেশি শক্ত ডিম এবং পাথর তা পারেনি। এটাই হচ্ছে মধ্যম পন্থা যা ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়।

সুরা আল ফুরকানে আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দাহদের গুণাবলী উল্লেখ করা হয়েছে:
১. তারা চাল চলনে বিনয়ী।
২. তারা অজ্ঞ মুর্খ লোকদের মুর্খতা ও অজ্ঞতা প্রসুত তর্কে জড়িয়ে পড়ে না।
৩. তারা রাত্রি জাগরণ করে। ইবাদত বান্দেগীতে সময় কাটায়।
৪. তারা আখেরাতের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য পেরেশান থাকে এবং এজন্য আল্লাহর কাছে কাকুতি মিনতি করে দোয়া করে।
৫. অর্থনৈতিক জীবনে ভারসাম্যমুলক জীবনে তারা অভস্থ। তারা যেমন বাজে খরচ ও করে না তেমনি কৃপনতাও   করেনা।
৬. তারা আল্লাহর সাথে শিরক করেনা। আল্লাহকে ডাকতে গিয়ে কাউকে তার সাথে শরীক করেনা।
৭. তারা মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করেনা।
৮. তারা যেনা ব্যভিচার করেনা।
৯. তারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়না। মিথ্যার পর্যায়ে পড়ে এমন কিছু তারা দেখতেও যায়না।
১০. তারা অর্থহীন কিছুর সামনে পড়লে সম্মানমুলক রাস্তা বের করে তাকে পাশ কাটিয়ে যায়
১১. তাদেরকে কোন ব্যাপারে আল্লাহর কোন আয়াতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হলে তারা তা মন দিয়ে শোনা এবং বোঝার চেষ্টা করে। অন্ধ ও বধিরের মত না দেখা না শোনার মত আচরন করে না।
১২. তারা স্বামী স্ত্রী উভয়ে পরস্পরের উত্তম আমল আখলাকের জন্য নিজেরা সহযোগিতা ও পূর্ণ চেষ্টা করে এবং আল্লাহর কাছেও এর জন্য সাহায্য চায়। সেইর সাথে সন্তান সন্ততি এবং গোটা পরিবারকে একটি আদর্শ পরিবার বানানোর জন্য চেষ্টা করে।আল্লাহর কাছে সাহায্য চায়।

 সুরা রাদের ২০ থেকে ২২ নং আয়াতে মুমিনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে:
১. তারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পুর্ণ করবে। কোন প্রকারের চুক্তি লঙ্গন করবে না।
২. আত্মীয়তার বন্ধন রাখার চেষ্টা করবে।
৩. আল্লাহকে ভয় করবে।
৪. আখিরাতে হিসাবের পরিনতিকে ভয় করবে।
৫.আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় সবর করবে।
৬. নামাজ কয়েম করবে।
৭. আল্লাহর দেয়া রিজিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে খরচ করবে।
৮. দুর্ব্যবহারের মোকাবেলায় সদ্ব্যাবহার করবে। ভালো দিয়ে খারাপের মোকাবেলা করবে।
কোরআনের আলোকে যদি আমরা আমাদের চরিত্রকে গড়ে তুলতে পারি তাহলে আমাদের সামনের সব বাধা সরে যাবে। সৌরভ ছড়িয়ে পড়বে চতুর্দিকে। যেমনি সৌরভ ছড়ায় কপি বিন। মনে রাখতে হবে কপি বিন কিন্তু তার চরিত্র বদলায়নি। রং গন্ধ সব ঠিক রেখেই সে সৌরভ ছড়িয়েছে।

No comments:

Post a Comment