ঘটনা-১
হাসান সাহেব বড় স্যারের রুমে ঢুকে সালাম দিলেন। হাতের ফাইলটা সাইন করিয়ে নিয়ে কিবরিয়া সাহেবের ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ শুরু করে দিলেন স্যারের সাথে। কিবরিয়া সাহেবের প্রোমোশন যেন না হয়, সেজন্য উনার ব্যাপারে সত্য মিথ্যা যা বলার বলে রুম থেকে বের হলেন। কিবরিয়া সাহেবের উপর অন্তরের ক্ষোভটা মিটানোর চেষ্টা করলেন। মনে হলো ক্ষোভ মিটেছে। আসলে ক্ষোভ যায়নি, বরং মনে খুঁতখুঁত আরো বেড়ে গেলো, অন্তরের জ্বালা আরো বাড়লো। প্রোমোশনটা কীভাবে আটকানো যায়, সেজন্য আরো প্ল্যান প্রোগ্রাম করতে লাগলেন।
ঘটনা-২
রাজনৈতিক কারণে শিহাবের চাকরিটা চলে গিয়েছে। একসাথে পঁয়তাল্লিশ জন নিয়োগ পেয়েছিল তারা। মাত্র আট জনের চাকরি আছে। মুনিব তার কাছের সহকর্মী। তার চাকরিটা ভাগ্যক্রমে রয়ে যায়। কেনো মুনিবের চাকরিটা আছে, সেজন্য প্রায় সময়ই ফোন করে মুনিবকে কথা শোনায় শিহাব। একে তো শিহাবের চাকরি নাই, তার উপর মুনিব মাস শেষে টাকা পেয়ে যাচ্ছে, এই মনঃকষ্টে শিহাব ঘুমাতে পারে না। অন্তরের জ্বালা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে তার। মুনিবকে আর পছন্দ করে না সে।
ঘটনা-৩
সাকিব তার ছোট মামার সাথে ব্যবসা করে। মৌখিক চুক্তি অনুযায়ী ব্যবসার টাকা দুই জন সমান সমান পাবে। আপন মামা, তাই কাগজ কলমে লিখিত চুক্তি হয়নি। কিন্তু ব্যবসার লাভের টাকা ছোট মামা বিভিন্ন ছল চাতুরী করে সাকিবকে দেয় না। সাকিব সরল মনে মামাকে বিশ্বাস করে ব্যবসা চালিয়ে যায়। সাকিবকে কখনো নিজের স্ট্যাটাসের উপর উঠতে দেওয়া যাবে না, এই চিন্তায় ছোটমামা সারাক্ষণ ফন্দিফিকির করতে থাকে। উঠতে বসতে ছোটমামার মনে শুধু এই চিন্তা। টাকা হাতিয়ে নিয়েও শান্তি পায় না মনে। অন্তরের জ্বালা, বড় জ্বালা।
ঘটনা-৪
দিন দিন মনিরুলের ব্যবসা ক্ষতির দিকে যাচ্ছে। সংসার চালাতে পারছে না। কাউকে বলতেও পারছে না। এমনকি বাবা-মা, ভাই-বোনকেও বলতে পারছে না, আত্মীয়স্বজন তো দূরের কথা। অথচ তার অবস্থার কথা কম বেশী সবাই জানে। মনিরুল কারো কাছে চাইতে পারে না। চাওয়ার অভ্যাস তার নেই। সারা জীবন দিয়ে এসেছে। মনিরুল যদি টাকা চেয়ে বসে, সেজন্য ভয়ে অনেকে জিজ্ঞেসও করে না কেমন করে সংসার চলে তার। আবার কেউ কেউ মনিরুলকে বলে, ‘টাকার প্রয়োজন লাগলে চেয়ে নিও’। অথচ কারো দেওয়ার মন মানসিকতা থাকলে কাছে এসে টাকা দিতে পারে, কিম্বা পরামর্শ দিতে পারে কিভাবে উপার্জন করা যায় অথবা চাকরি দিতে পারে অথবা দিতে পারে মৌখিক সান্ত্বনা। জীবনের বেশীরভাগ সময় ব্যবসার কাজে দেশ বিদেশ ঘুরেছে, ভালো অবস্থায় থেকেছে মনিরুল। এখন রক্তের এই সম্পর্কের মানুষগুলো তার এই অবস্থায় খুশী হয়, তাচ্ছিল্য করে বলে, জীবনে মজা করেছো অনেক, এখন কষ্ট কর। মনিরুল অবাক হয়, এতোদিন সে যে ভালো অবস্থায় ছিল, সেটা আপনজনেরা একদম মেনে নিতে পারেননি। কেনো তাদের কাছে হাত পাতছে না, সেটাতেও তাদের ক্ষোভ।
ঘটনা-৫
রুনির বিশাল বড় ফ্ল্যাটে প্রায়ই বেড়াতে আসে ছোট বোন টুনি। এতো বড় ফ্ল্যাট, সাজানো সংসার দেখে ভালো লাগে টুনির। একদিন বেড়াতে এসে রুনির মন খারাপ দেখে জানতে পারলো, রুনির হাজব্যান্ডের একটা জাহাজ পানিতে ডুবে গিয়েছে। শুনে সান্ত্বনা দিলো রুনিকে, কিন্তু অন্তরে একটু খুশীর ঢেউ বয়ে গেলো।
উপরের ঘটনাগুলো পরিচিত মনে হচ্ছে? ঘটনাগুলো সত্য। এরকম আরো ঘটনা আমাদের চারপাশে আছে। অমুক কেনো পিএইচডি ডিগ্রী পেয়েছে, অমুকের ছেলে মেয়ে কেনো ভালো জায়গায় পড়ছে, কেনো মানুষটা ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরী করছে, কেনো মানুষটার ব্যবসা দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছে, কেনো মানুষটা প্রতি বছর হজ্জে যায়, কেনো মানুষটা অল্পতেও খুশী থাকে, কেনো সে গাড়ী কিনলো, কেনো মানুষটা পরিবার নিয়ে সুখী, কেনো মানুষটা একটা ভালো বাসায় থাকে, কেনো মানুষটা এতো সুন্দর, কেনো তার ভালো একটা পরিবারে বিয়ে হয়েছে, এমন অনেক অনেক চিন্তা মানুষের মাথায় আসে। এমন প্রতিটা চিন্তা ব্যক্তির অন্তরকে অস্থির করে রাখে। এই যে অন্যের ভালো অবস্থা দেখে যদি অসহ্য লাগে এবং মনে মনে এই কামনা করা হয় যে, তার এই ভালো অবস্থা না থাকুক এবং অকল্যাণ হোক, অন্তরে জ্বালা অনুভব হয়, অন্যের ক্ষতিতে মনে শান্তি আসে, এটা অন্তরের রোগ। এই রোগের নাম হচ্ছে হাসাদ বা হিংসা।
আসমানে ও জমিনে প্রথম যে গুনাহ সংঘটিত হয়, সেটা হচ্ছে হিংসা । শয়তানের মনে হিংসার কারণেই অহংকার আসে, তাই সে আদম আলাইহে ওয়া সাল্লামকে সিজদাহ করেনি। আর কাবিল তার বড় ভাই হাবিল কে হিংসা করে মেরে ফেলে।
হিংসা করা কবীরা গুনাহ। সহীহ বুখারির ৭৫২৯ নাম্বার হাদিস থেকে জানতে পারি যে, জান্নাতে কোনো হিংসা থাকবে না। অর্থাৎ জান্নাতিদের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা হিংসুক হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতে মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন।(সুনান ইবনু মাজাহ, হাদিস নাম্বারঃ ১৩৯০) তার মানে আল্লাহ্’র ক্ষমা পেতে হলে, জান্নাত পেতে হলে অন্তরের জ্বলন অর্থাৎ হিংসা দূর করতে হবে।
আচ্ছা বলুন তো, চূড়ান্ত সফলতা কি? চূড়ান্ত সফলতা হচ্ছে জান্নাত লাভ করা। এখন আমার আপনার অন্তরে যদি এই রোগ থাকে , তাহলে কি চূড়ান্ত সফলতা লাভ করতে পারবো?
দুনিয়াতে কে না সুখী হতে চায়! অথচ আপনি কখনোই একই সাথে হিংসুক ও সুখী হতে পারবেন না । কারণ হিংসুক সারাক্ষণ মনে মনে চিন্তা করতে থাকে কিভাবে অন্যের ক্ষতি করা যায় অথবা কেনো অন্যরা তার থেকে ভালো আছে। অর্থাৎ মনে শান্তি পায় না তারা। এই যে অন্তরের জ্বলন, এই যে অন্তরের অশান্তি, এটা এক ধরণের আযাব। অন্তরের এই অশান্তির কারণে অনেকে শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, হিংসা কেবল মনের প্রশান্তিই নষ্ট করে না, বরং এটি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকেও দুর্বল করে দেয়। কারণ সে তখন তাকদীর কে বিশ্বাস করে না।
প্রতিটি মানুষের রিযক নির্ধারিত। আল্লাহ্ মানুষকে কম ও বেশী রিযক দেন। মূলতঃ এটা মানুষের জন্য পরীক্ষা। তাছাড়া আল্লাহ্ জানেন কার জন্য কি দরকার, তিনিই সর্বোচ্চ ন্যায়বিচারক। অথচ যখন কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির প্রতি হিংসা করে, তখন সে নিজের অজান্তেই মনে করে যে আল্লাহ্ তার প্রতি ইনসাফ করেননি, অন্যকে বেশী এবং তাকে কম দিয়েছে, আল্লাহ্’কে দোষ দিয়ে দেয়, নাউজুবিল্লাহ। হিংসুক ব্যক্তি যে আল্লাহ্’কে দোষ দিয়ে দেয়, সেটা সে উপলব্ধি করতেই পারে না। কারণ সেটা উপলব্ধি করার মতন জ্ঞান তার নেই।
তাহলে নিজেকে যাচাই করে দেখি তো, আমার অন্তরে কি এই অন্তর জ্বালা আছে? যদি থাকে, তাহলে কিসের জন্য অন্তর জ্বালা আমার মনে?
যাকে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয় হঠাৎ তার উন্নতি দেখলে অন্তরে জ্বালা আসতে পারে, শত্রুতার কারণে হিংসা আসে মনে, আবার একই শ্রেনীর কেউ উন্নতি করে ফেললে মনে হিংসা হতে পারে অথবা অনেকসময় নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্যও হিংসা আসে মনে।
যদি এই অন্তর জ্বালা নিজের মাঝে অনুভূত হয়, সাথে সাথে মনে করা উচিৎ, যার উন্নতি হচ্ছে বা ভালো কিছু হচ্ছে, তার তাকদীরে উন্নতি বা ভালো কিছু লেখা আছে বলেই উন্নতি হচ্ছে। এখন যদি তাকে হিংসা করা হয়, তাহলে আল্লাহ্’র তাকদীর অস্বীকার করার মত গুনাহ হবে।
তাছাড়া আরো কিছু অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে নিজের অন্তরে প্রশান্তি আসবে। যেমন, কারো সাথে দুনিয়াবি বিষয়ে প্রতিযোগিতা না করে, আখিরাতের বিষয়ে প্রতিযোগিতা করা, অন্যের জন্য কল্যাণ কামনা করে দু’আ করা, সবার সাথে ভালো ব্যবহার করা, নিজের যেটা আছে, সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন হিংসা পরিহার করতে। কারণ হিংসা ভাল কাজকে সেভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন কাঠকে খায় অর্থাৎ জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। (সূনান আবু দাউদ, হাদিস নাম্বারঃ ৪৮২৩, ৪৯০৩) তাহলে চিন্তা করুন, আপনি কত ভালো কাজ করে যাচ্ছেন, কিন্তু সেটার কোনো মূল্য থাকবে না হিংসা করার জন্য।
তবে আরেকটা ব্যাপার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একমাত্র দু’টি বিষয়ে হিংসা করা যায়। একজন হচ্ছে, যাকে আল্লাহ কুরআন (মুখস্থ করার শক্তি) দান করেছেন, সুতরাং সে তার (আলোকে) দিবা-রাত্রি পড়ে ও আমল করে। আরেকজন হচ্ছে, যাকে আল্লাহ তা‘আলা ধন-সম্পদ দান করেছেন এবং সে (আল্লাহর পথে) দিন-রাত ব্যয় করে। (বুখারি, হাদিস নাম্বারঃ ৭৫২৯)
একটা খারাপ কাজ আরেকটা খারাপ কাজকে টেনে আনে। হিংসার ক্ষেত্রে দেখা যায়, হিংসুক ব্যক্তি যাকে হিংসা করে তার নামে গীবত করে, চোগলখোরি করে, অহংকার করে, কিন্ত সামনাসামনি খুব তোষামোদ করে। শুধু সেটা না, হিংসুক ব্যক্তি মানুষের বিভিন্ন ক্ষতি করে ফেলে, সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলে, ক্ষেত্র বিশেষে মানুষকে মেরেও ফেলে। চিন্তা করেন, হিংসার কারণে কতগুলো খারাপ কাজ মানুষ করে ফেলে! হিংসুক আসলে নিজের ইহলৌকিক এবং পরলৌকিক জীবন নষ্ট করে ফেলে।
নিজের আত্মাকে যেমন হিংসা থেকে বাঁচানো দরকার, তেমনি অন্যের হিংসা থেকে নিজেকে রক্ষা করাও দরকার।
সহীহ মুসলিমের ৫৫১১ নাম্বার হাদিস থেকে জানা যায়, জিবরাঈল আলাইহে ওয়া সাল্লাম নিজে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অপরের হিংসা থেকে বাঁচার জন্য দু’আ করে গিয়েছেন, দু’আ শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। সূরা ফালাক্বের পাঁচ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ্ শিখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে হিংসুকের হিংসা থেকে বাঁচার জন্য দু’আ করতে হয়। সর্বক্ষন আল্লাহ্’র উপর ভরসা করতে হবে, কারণ আল্লাহ্ কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন মুমিনদের আল্লাহ্’র উপর ভরসা করতে। যে ব্যক্তি আল্লাহ্’র উপর ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট। সূরা তালাকের এই তিন নাম্বার আয়াতটা তো সবার মুখে মুখে শোভা পায়, কিন্তু সত্যিকার ভাবে কয়জন এই আয়াতের উপর আমল করতে পারি?
লেখাটা শেষ করি একটা হাদিস বর্ননা করে।
যুবাইর ইবনুল আওয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের রোগ তোমাদের মাঝেও সংক্রমিত হবে। তা হল হিংসা ও বিদ্বেষ। এ হল মুন্ডনকারী। আমি বলি না যে, তা চুল মুন্ডন করে বরং তা দ্বীনকে মুন্ডন (ধ্বংস) করে দেয়। যাঁর হাতে প্রাণ সে সত্তার কসম, তোমরা মু‘মিন না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে দাখেল হতে পারবে না। আর তোমরা মু‘মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না পরস্পরকে ভালবেসেছ। এই ভালবাসা কেমন করে সুদৃঢ় হয় তা তোমাদের বলব কি? তা হল পরস্পর সালামের প্রসার ঘটাও। (তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ২৫১০, আল মাদানী প্রকাশনী)
আসুন, অন্তর জ্বালা দূর করি, হিংসা থেকে বাঁচি, সালামের প্রসার ঘটাই, জান্নাতে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বলি। যিনি যত বেশী ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বলতে পারবেন, তিনি তত বেশী অন্তর জ্বালা থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন এবং সফল হতে পারবেন ইন শা আল্লাহ্।
অন্তর জ্বলে রে জ্বলে
তাহ্নিয়া ইসলাম খান