Saturday, May 15, 2021

শতাব্দীর নিকৃষ্টতম ফিতনা ও তরুণ প্রজন্ম

 

শতাব্দীর নিকৃষ্টতম ফিতনা ও তরুণ প্রজন্ম

 

 

[এক]
মাদকাসক্তি, হারাম প্রেমের সম্পর্ক, পর্ণ আসক্তি এমনকি নাস্তিকতাও নয় যুব সমাজের দিকে ধেয়ে আসছে শতাব্দীর নিকৃষ্টতম ফিতনা। এই ফিতনাকে বলা যেতে পারে বর্তমান সমাজে প্রচলিত নৈতিকতার অবক্ষয়, মাদকাসক্তি, হারাম সম্পর্ক, পর্ণ আসক্তি, পর্দা বিমুখতা, পিতামাতার অবাধ্যতা, প্রকাশ্য কুফরি এবং ধর্ষণসহ সকল প্রকার পাপাচারের জননী। এই ক্ষেত্রে একটুখানি অপরিণামদর্শিতার ফলে গুণতে হতে পারে চরম মাশুল। বলছি সেই ফিতনার কথা যে ফিতনায় জড়িয়ে থাকা মানুষগুলো বুঝতেও পারে না যে তারা ভয়ানক পাপাচারে লিপ্ত। যে ফিতনা গুটি গুটি পায়ে বিস্তার লাভ করে গ্রাস করে ফেলবে সম্পূর্ণ উম্মাহকে। যাকে বলে সুঁই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হওয়া।

এই ফিতনাকে আরও সূক্ষ্ম ভাবে সংজ্ঞায়িত করতে তুলনা করা যেতে পারে ধীর গতির বিষক্রিয়ার সাথে। যে বিষের বীজ একবার সমাজে বপন করতে পারলে ফলন পাওয়া যাবে বহুকাল। ফলন পেতে যথেষ্ট সময় লাগলেও একটি মাত্র বীজ থেকে পাওয়া যাবে হরেক রকমের ফসল। অর্থাৎ একটি মাত্র পাপের বীজের দ্বারা অনেক রকমের পাপকে বৈধতা দেয়া যাবে। এজন্যই বলেছিলাম, এই ফিতনা হচ্ছে শতাব্দীর নিকৃষ্টতম ফিতনা এবং বর্তমানে প্রচলিত সকল পাপের জননী।

উপরোক্ত ফিতনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ধূমপান। যদিও ধূমপান এই ফিতনার পরিণামের বিচারে ধারে কাছেও নেই তবে দীর্ঘসূত্রিতার বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একই কাতারে রাখা যেতে পারে। দুটো ফিতনারই পরিণাম দৃষ্টিগোচর হতে যথেষ্ট সময় লাগে। আর ধূমপানকে বলা যায় নেশার জগতে পদার্পণের প্রবেশ পথ। যে পথের শুরু আছে কিন্তু শেষ কোথায় সে পথের পথিকও জানে না। ধোঁয়ার সাথে তৈরি হওয়া প্রণয়ের করুণ উপাখ্যান লিখে ক্যান্সার নামক মরণব্যধি। এই পথের পথিক এমন এক ধোঁয়াটে এবং অন্ধকার জগতে হারিয়ে যায় যেখান থেকে ফিরে আসা মরুভূমিতে পানির সন্ধান পাওয়ার সমান।

এই জগতে পদার্পণের শুরুটা নিকোটিনের তিক্ত স্বাদের সাথে হলেও এই পথচলা নিকোটিনেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এই পথচলায় নতুনত্বের মিশেলে যুক্ত হয় অভিনব সব উপকরণ। যা তাকে নিয়ে যায় ধ্বংসলীলার চূড়ান্ত পর্যায়ে। এই পথের পথিক চোখের পলকে নেশার জগতে আসক্ত হয়ে উঠেনি। দীর্ঘদিনের ধ্বংসাত্মক পথের যাত্রার ফলে আজ অংশীদার হয়েছে এই ভয়ানক ধ্বংসলীলার। এই ধ্বংসের পথে চলতে চলতে এই পথকেই সুন্দর স্বাভাবিক মনে করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে এই ধ্বংসের পথকেই নিজের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে নেয়। দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিজের মানসিক অসুস্থতাকে মেনে নিতে পারে না বরং নিজেকে মনে করে সুস্থ এবং স্বাভাবিক। একজন আসক্ত ব্যক্তি কখনো বুঝতে পারে না সে আসক্ত, হোক সেটা মাদক বা সিনেমা অথবা অন্য যেকোনো কিছু। এই মাদকাসক্ত ব্যক্তি দীর্ঘদিনের অসুস্থতার সর্বশেষ পরিণতি হিসেবে নাম লেখায় এপিটাফে।

[দুই]
একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি যেমন দীর্ঘদিনের অসুস্থতার দরুন মেনে নিতে পারে না সে অসুস্থ ঠিক একই কথা প্রযোজ্য শতাব্দীর এই নিকৃষ্টতম ফিতনার ক্ষেত্রেও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ উপলব্ধিই করতে পারে না তার দ্বারা ইসলামের এবং উম্মাহর এত বড় ক্ষতিসাধন হচ্ছে, অসুস্থতা মেনে নেয়া তো অনেক দূরের কথা। পূর্বে বলেছিলাম সকল পাপের জননী হচ্ছে আজকের এই ভয়ানক ফিতনা, কিন্তু পরিতাপের বিষয় এটাও সর্বসাধারণ উপলব্ধি করতে পারছে না।

এই শতাব্দীর নিকৃষ্টতম, ভয়ানক ফিতনা হচ্ছে উদারনৈতিকতা বা লিবেরেলিজম। এটা এমন এক ধীর গতির বিষ যা সম্পূর্ণ উম্মাহকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য একাই যথেষ্ট। ইতিমধ্যেই উদার নৈতিকতার ভয়াল পরিণতি সকলের দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করেছে। যুব সমাজের বিশাল একটি অংশের চিন্তা ভাবনা আজ উদারনৈতিক। আজকের প্রজন্ম উদারনৈতিকতায় এতটাই আসক্ত হয়ে গিয়েছে যে তারা তার দ্বীনকে বিকিয়ে দিতেও দ্বিধা করছে না। দ্বীনের অবশ্য পালনীয় বিষয়গুলোকে ছাড় দিতে শুরু করেছে। ফলাফল স্বরূপ অদূর ভবিষ্যতের ধ্বংসলীলার ভয়াল থাবা একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তির কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।

RAND Corporation রিসার্চ পাবলিশ করেছে কীভাবে মাছের তৈল দিয়ে মাছ ভাঁজা যায়, অর্থাৎ মুসলমানদের দিয়েই সম্পূর্ণ উম্মাহর উপর কীভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো যায়। অনেকটা “সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না”-এর মত ব্যাপার। নীরব ঘাতকের ন্যায় পেছন থেকে উম্মাহকে ধ্বংস করে যাবে কিন্তু কেউ সেটা বুঝতেও পারবে না, আর বুঝতেই যখন পারবে না তবে কিসের আর জবাবদিহিতা। আধুনিকতার সংমিশ্রণে প্রকাশ্য সামরিক যুদ্ধ প্রায় গত হয়েগ। একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য আজ আর তাদের উপর কামান, গোলাবারুদ, বিমান হামলার দরকার নেই; তাদের সভ্যতা, কৃষ্টি-কালচার ধ্বংস করে দাও তারা এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে। আমরা হাতে না মেরে ভাতে মারার প্রবাদ শুনেছি, আর এটাই হচ্ছে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই সূক্ষ্ম কর্ম সম্পাদনের জন্য তারা ব্যবহার করছে আমাদেরই মধ্য থেকেই বিপথগামী এক তরুণ প্রজন্মকে। যাদেরকে বলা যায় ঘরের শত্রু বিভীষণ। বিভীষণ যেমন নিজ জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেও ইতিহাসে হিরো হয়ে আছে তেমনিভাবে এ যুগের বিভীষণরাও তাই। মানুষের চোখে তারা আজ হিরো, লক্ষ লক্ষ তাদের অনুসারী। পাশ্চাত্যের গবেষণার নথিপত্রে এ যুগের বিভীষণদের নামকরণ করা হয়েছে মোডারেট মুসলিম [১]। আর যে ছাঁচে ফেলে মোডারেট মুসলিমের সত্যতা যাচাই করা হয় সেটা হচ্ছে মোডারেট ইসলাম।

মোডারেট ইসলাম আদতে কি? কে বা কারা মোডারেট মুসলিম? কি কি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মোডারেট মুসলিমদের সনাক্ত করা যায়? পাশ্চাত্যের লিবারালিজম বা উদারনৈতিকতা সমর্থনে উম্মাহর সর্বশেষ পরিণতি কি হতে পারে? এক্ষেত্রে সামান্যতম অপরিণামদর্শিতার মাশুল কি পরিমাণ দিতে হতে পারে ইত্যাদি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্ন নিয়েই আজকের বিস্তারিত আলোচনা। ধীরে ধীরে সকল প্রশ্নের উত্তর আজকের আলোচনায় উঠে আসবে ইনশাআল্লাহ্‌। বলে রাখা ভালো এযাবতকালে উম্মাহ যত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে, উদারনৈতিকতার নামে মোডারেট ইসলামের প্রচার এবং প্রসার। দীর্ঘমেয়াদে যার পরিণতি আমাদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলতে পারে।

পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিদের প্ররোচনায় তরুণ প্রজন্মের বিশাল একটি অংশ আজ বিপথগামী। হালের বিভীষণের ষড়যন্ত্রে আজ তারা যেন এক ঘোরের মধ্যে বসবাস করছে। নিজেদের মধ্যে লালন করছে পাশ্চাত্য ভাবধারা। তরুণ প্রজন্ম পাশ্চাত্যের ভাবধারা একটু একটু করে ধারণ করছে নিজেদের মধ্যে, আর নিজেরা ধারণ করতে না পারলে ঠুসে ঠুসে দেয়ার জন্যে তো আছেই এ যুগের বিভীষণ সম্প্রদায়। এই উদারনৈতিক মতবাদকে কেউ স্বেচ্ছায় মেনে নিচ্ছে তো কেউ না বুঝেই গোগ্রাসে গিলে নিচ্ছে। এই প্রজন্ম যেমন আন্তরিকতার সাথে পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করে এবং যে সকল ধ্যান ধারনা নিজের মধ্যে লালন করে ঠিক একইভাবে যদি ইসলামকে অনুসরণ করত, ইসলামের বিধি-নিষেধকে মেনে চলত তবে দুনিয়াটাই এক টুকরো জান্নাতে পরিণত হত। কিন্তু আফসোস আজ মেসিকে অনুসরণ করার মানুষের কোন অভাব নেই কিন্তু মুহাম্মাদ (সাঃ) অনুসরণ করার মানুষের বড্ড অভাব। এটা তুলনা নয় আক্ষেপ! হ্যাঁ চরম আক্ষেপ!!!

পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিরা আজ আধুনিকতার নামে ইসলাম বহির্ভূত এবং সাংঘর্ষিক কর্মকাণ্ডকে উসকে দিচ্ছে, পরিতাপের বিষয় আমরা এমন হীন কর্মকাণ্ডকেও গোগ্রাসে গিলছি। ঠিক যেন একটি নীল তিমি। আসলে নীল তিমিও না, এর থেকেও নিচের পর্যায়ের প্রাণী। নীল তিমি অন্তত মুখের মধ্যে যা আসে অর্থাৎ খাদ্য অখাদ্য সবই ভক্ষণ করে কিন্তু আমরা শুধুমাত্র অখাদ্যই পেটে চালান দিয়ে যাচ্ছি। পশ্চিমাদের অনুসরণে আমরা এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছি যে প্রকাশ্য কুফরও আমাদের দৃষ্টিসীমার অন্তরালেই রয়ে যাচ্ছে। আজ আমরা ভিন্নমতাদর্শীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নামে প্রকাশ্য কুফরিকে বৈধতা দিতে চাই। যেমনঃ LGBT অধিকার, নাস্তিক, শিয়া, কাদিয়ানী ইত্যাদি প্রমুখ।

সমস্যা যেহেতু বহুমুখী সেহেতু এযাবতকালে তরুণ প্রজন্মের অনুধাবন করা অনেক অসঙ্গতিই এখানে আলোচিত হবে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এমন অনেক সমস্যা আছে যা কেবলমাত্র উদারনৈতিক চিন্তা ভাবনার ফলেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এসকল বিষয়ও এখানে আলোচনার ফলে লেখার কলেবরও অনেক বড় হয়ে যাওয়ার আশংকা করছি, তবে এতে কোন প্রকার অনুশোচনা নেই। পাঠক এই যুগের অভিনব ফিতনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণ পেলেই আমার সার্থকতা। আর যেহেতু সমস্যা বললেই লেখক হিসেবে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না সেহেতু সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায়ও বাতলে দেয়ার চেষ্টা করব বাকিটা মহান রবের ইচ্ছা। যাইহোক আলোচনায় ফিরে আসি।

[তিন]
আমাদের তরুণ প্রজন্ম গণতন্ত্রের গুণকীর্তন চর্চায় এতটাই মগ্ন যে তারা ভুলেই গিয়েছে গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়গুলো ইসলামের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এই সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো সঠিক বলে মেনে নেয়া এবং বিশ্বাস করা ক্ষেত্র বিশেষে শিরকের মত জঘন্য অপরাধের জন্ম দেয়। যেমন এই গণতন্ত্রের সংবিধানে বলা আছে, “সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ”, যা প্রকাশ্য শিরক [২]। একজন মুমিন মাত্রই বিশ্বাস করে সকল ক্ষমতার উৎস একমাত্র মহান আল্লাহ্‌ সুবাহানাহু তাআলা। আপনি যদি গণতন্ত্রকে বাধ্য হয়ে মেনে সেটা ভিন্ন ব্যাপার, কিন্তু এটাকে সঠিক মনে করে বিশ্বাস করা শিরক। এই মানবসৃষ্ট গণতান্ত্রিক সংবিধানে আরও বলা হয়েছে ধর্মীয় নিরপেক্ষতার কথা, ধর্ম চর্চার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার কথা [৩]। যা সরাসরি মুরতাদকে উৎসাহিত করে। যার ফলে নাস্তিকতার প্রসার আজকাল ডালভাতে পরিণত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তচিন্তার নামে যার যখন ইচ্ছা ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করা এবং নবী (সাঃ) কে গালাগালি প্রতিনিয়ত চলমান।

আজকের প্রজন্ম আল্লাহ্‌ সুবাহানাহু তাআলার আইনকে অমান্য করে মানবসৃষ্ট আইন দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে যা তাগুদের উদাহরণ। শুধু তাই নয়, এই সুশীলরা কিছু ক্ষেত্রে আল্লাহর আইনকে বাড়াবাড়ি মনে করে। যেমন তারা হুদুদ তথা ইসলামি আইন এবং এর দণ্ডবিধানকে অস্বীকার করে। তারা বলে চুরির শাস্তি স্বরূপ হাত কেটে ফেলা নির্দয়তা এবং তা সমর্থনযোগ্য নয়। এরকম আরও অনেক ক্ষেত্রেই তারা বাড়াবাড়ি করে। এই সুশীল সমাজ জানেই না, একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে একজন ব্যক্তি খেতে না পেয়ে চুরি করলে সে দেশের শাসক পর্যন্ত দায়বদ্ধ থাকে। ইসলাম এতটাই সুন্দর এবং পরিপূর্ণ জীবন-ব্যবস্থা।

গণতন্ত্র নিয়ে দুই একটি কথা না বললেই নয়। আজকের গণতন্ত্রে কেউ কারও কাছে দায়বদ্ধ নয়। জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি হলেও জবাবদিহিতা নেই। প্রধানমন্ত্রী হয়েও এমন অনেক ক্ষেত্রে কিছুই করার থাকে না। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে জবাবদিহি করাও প্রায় অসম্ভব, বিচারের আওতায় আনা বলতে গেলে অলীক কল্পনা। দুর্নীতি দমন কমিশন যখন দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তখন তাদের দুর্নীতির তদন্ত কে করবে? [৪] অন্যদিকে হক্ব ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে তরুণ প্রজন্মের কোন মাথা ব্যথাই নেই। তারা গণতন্ত্রের মত গোঁজামিলপূর্ণ, জোড়াতালি দেয়া ব্যবস্থাকেই সঠিক মনে করে। তাগুত নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনা অনেক ক্ষেত্রে জানেই না তাগুত আসলে কি? বর্তমান প্রজন্মের বিশাল একটি অংশ জিহাদ বলতে বোঝে জঙ্গিবাদকে। আসলেই কি তাই? কখনই না। জিহাদ ইসলামে অন্যতম ফরজ একটি ইবাদত। যার গুরুত্ব এবং ফযিলত আকাশচুম্বী। জিহাদে অংশগ্রহণকারী হয় শহীদ নতুবা গাজী। যাদের মর্যাদা এবং সম্মান অন্য সকলের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু আজ পশ্চিমের প্রতিনিধি দোসরদের প্ররোচনায় জিহাদের অর্থই যেন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।

আজকের প্রজন্ম সহিংসতাকে সমর্থনই করে না। জিহাদ কি? কখন করতে হবে সেটাও জানে না। পাশ্চাত্যের মোডারেট চিন্তাধারা ঠুসে ঠুসে মজ্জাগত করায় আমরা আজ ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো ভুলতে বসেছি। অথচ পাশের দেশেই নাগরিকত্ব সংশোধনের নামে মুসলিমদের উপর চলছে সহিংস আক্রমণ, নির্মম নির্যাতন [৫]। পরিস্থিতি এমন হয়েছে আমাদের প্রজন্ম সহিংসতা পছন্দ করে না, কিন্তু আমাদের উপরই নেমে আসে সহিংসতার ভয়াল থাবা। আমরা এটা বুঝিনা, বর্তমান পরিস্থিতিতে সহিংসতা ছাড়া ন্যায় প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। ইসলামি খেলাফতের প্রতিষ্ঠা সহিংসতার মাধ্যমেই হবে। কেউ এমনি এমনি খেলাফত দিয়ে যাবে না। আমি সহিংসতাকে উস্কানি দিচ্ছি না বা সমর্থনও করছি না বরং বোঝাতে চাচ্ছি পাশ্চাত্যের দোসররা যেমন অধিকারের নামে কুরুচিপূর্ণ যৌনতার বৈধতা চাইতে পারে, উম্মাহর উপর নির্মম অত্যাচার নির্যাতন করতে পারে। তবে আমরা কি এমন অধিকারের নামে চলা পাশ্চাত্যের দালালী কে রুখে দিতে পারিনা? মুসলমানদের উপর চলমান অকথ্য নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে পারিনা?

[চার]
আজকের যুব সমাজের বদ্ধমূল ধারনা ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম কি শুধুই শান্তির ধর্ম? শান্তি অর্জনের এই বন্ধুর পথ কি রক্তে রঞ্জিত হয়নি? আজও কি বিধর্মীদের অত্যাচারে উম্মাহর রক্তধারা বইছে না রাজপথে? আজকের তরুণ প্রজন্মকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় “ইসলাম শান্তির ধর্ম” কিন্তু কেন? যে ইসলামের পতাকাতলে অসংখ্য যুদ্ধের দামামা বেজেছে, নাঙ্গা তলোয়ারের আঘাতে অগণিত মানব সন্তানের মুণ্ডুপাত হয়েছে, বহু মানবের প্রাণ ভোমরা যুদ্ধের ময়দানে উড়াল দিয়েছে সবমিলিয়ে ইসলামের পতাকাতলে এত এত প্রাণবিয়োগের পরেও তোমরা কীভাবে ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলতে পারো? এমন প্রশ্নের কোন গ্রহণযোগ্য উত্তর আজকের প্রজন্মের কাছ থেকে পাওয়া যায়না। আজকের যুব সমাজ আবহমানকাল থেকে শুনে আসা “ইসলাম শান্তির ধর্ম”বাক্যটিকে যেন দৈব বানী হিসেবেই মেনে নিয়েছে। প্রজন্ম আজ ভুলে গিয়েছে ইসলাম শান্তির ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে ন্যায়ের ধর্ম। ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ইসলাম যে কোন কিছু করতে পারে হোক সেটা যুদ্ধ বা জিহাদ।

ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সংঘটিত যুদ্ধে প্রাণবিয়োগ ঘটবে এটা সূর্যের পূর্ব দিকে উদিত হওয়ার মতই সত্য। অর্থাৎ ইসলাম শান্তির ধর্ম অবশ্যই কিন্তু এর আগে ইসলাম ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অবিচল এক জীবন-ব্যবস্থা। ইসলাম ন্যায় প্রতিষ্ঠার সাথে অন্য কোন কিছুকে আপোষ করে না। ইসলামের একজন প্রকৃত অনুসারী ন্যায় প্রতিষ্ঠায় যেমন প্রাণ নিতে পারে তেমনিভাবে প্রাণ দিতেও দ্বিধা বোধ করে না। আর একজন প্রকৃত মুমিনকে দুনিয়াবি সম্পদের পাহাড় এনে দিলেও ইসলামের আদর্শকে কখনই বিকিয়ে দিবে না। বলে রাখা ভালো, যেখানে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হয় সেখানে আলাদা করে শান্তির সাদা পায়রা অথবা সবুজ নিশান উড়ানোর কোন প্রয়োজন পড়ে না। সেখানে আপনা আপনি শান্তি বৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় সকলের হৃদয় পরিতৃপ্ত হয়।

[পাঁচ]
আজকের প্রজন্ম মনে করে একমাত্র জাতিসংঘই শান্তির সাদা পায়রা। কিন্তু তারা জানেই না এই শান্তির সাদা পায়রার মুখোস ধারণ করেই বসনিয়া, ফিলিস্তিন এবং আফগানিস্তানে মুসলিমদের উপর অবর্ণনীয়, নির্মম অত্যাচার নির্যাতন করছে তাদেরই দোসররা। আজকের হলুদ রঙের মিডিয়া এ সকল বিষয়কে প্রকাশ করে না। যদি প্রকাশ করেও থাকে তবে সেটা বিকৃতভাবে। যেমনঃ তালেবানকে জঙ্গি সংগঠন বলা সেই মিডিয়াই কিন্তু আজ তাদের বিদ্রোহী এবং স্বাধীনতাকামী বলে আখ্যা দিচ্ছে। দুটি শব্দেরই কিন্তু ভাবগত দিক থেকে বিস্তর পার্থক্য। পাশ্চাত্য ও তাদের প্রতিনিধি হলুদ সাংবাদিকরা গিরগিটী থেকেও দ্রুত তাদের রঙ বদলায়। তালেবানের প্রতি বর্তমানের এই সহানুভূতি প্রমাণ করে “History is written by the winner” অর্থাৎ “বিজয়ীর দ্বারাই ইতিহাস রচিত হয়”।

এই বাইরে চলমান রোহিঙ্গা সংকট, ভারতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতা নিয়ে এই শান্তির পায়রার তেমন কোন হাঁক ডাক শোনা যায়না। এই মুসলিম সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের কোন প্রতিবাদ তারা করেনা, জবাবদিহিতা তো অনেক দূরের ব্যাপার। চীন বিপরীত ব্লকের হওয়ায় উইঘুরে চলা সহিংসতার একটি চিত্র তারা তুলে ধরেছে কিন্তু কাজের কাজ কি কিছু হয়েছে? আসলে তারা নিজেদের দোসরদের দোষ প্রকাশ্যে নিয়ে আসেনা, আর যাদেরটা নিয়ে তাদের একটি চুলও বাঁকা করতে পারেনা। আমি মাঝে মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পরে যাই আসলে তাদের কার্যক্রমগুলো কি? সবটাই কি ফাঁকা বুলি? এতকিছুর পরও আজ বিশ্বের অনেকের কাছে এবং আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে শান্তির দূত সবুজের একমাত্র নিশান জাতিসংঘ।

এই শান্তির দূতও দেখবেন মানবাধিকারের সবুজ নিশান উড়ায়, বাকুম বাকুম করে সাদা পায়রার মত বুলিও শোনায়। কিন্তু এগুলো সবই নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে। সর্বোপরি, তাদের মানবাধিকার চর্চা তথা শান্তির পতাকা সর্বদাই ইসলামের বিধিনিষেধের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। যেমন তারা বলে নারী অধিকার তথা নারী স্বাধীনতা এবং সমকামী অধিকারের কথা[৬]। তারা আরও বলে মুক্তচিন্তার স্বাধীনতার কথা [৭]। পরিশুদ্ধ বাংলায় আমরা যাকে বলি নাস্তিকতা। একবারও ভেবে দেখেছেন তাদের এত সুন্দর সুন্দর বুলি সর্বদাই কেন ইসলাম বিরোধী হয়? কারণ একটাই তারাও পাশ্চাত্যেরই অংশ। পাশ্চাত্যের মত তারাও চায় ইসলামকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন করতে। কাটছাঁট করে তাদের তৈরি ছাঁচে ফেলে মোডারেট ইসলামের প্রচার করতে। এতকিছুর পরও আমাদের তরুণ প্রজন্ম তাদের বক্তব্যকে দৈববাণী হিসেবে মেনে নেয় এবং মনে করে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকা উচিৎ। নারী স্বাধীনতার নামে অশ্লীলতার উস্কানিকেও তারা আজ বৈধ মনে করে। আর পরিপূর্ণ পর্দাকে মনে করে বাড়াবাড়ি।

[ছয়]
সমঅধিকারের প্রশ্নে বর্তমান সময়ের বিক্রয়কর্মীর ব্যাপারটি আলোচনা করা যেতে পারে। আধুনিকতা আর নারী স্বাধীনতার নামে চলছে অশ্লীলতার রমরমা ব্যবসা। আজকাল মোবাইল ফোন কেনার জন্য শপিং মলে ঢুকলে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে উঠার যোগাড়। সেখানে আজ আর পুরুষ বিক্রয়কর্মী নেই, আজ সেখানে নারী বিক্রয় কর্মীর ছড়াছড়ি [৮]। এখানে বোঝার উপায় নেই আপনি কোন শপিং মলে ঢুকেছেন নাকি কোন বিউটি পার্লারে। শুধু কি শপিং মল? সমাজের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নারীকে সাজিয়ে গুঁজিয়ে উপস্থাপন আজ পান্তাভাত হয়ে গিয়েছে। অশ্লীলতা পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যা সালাফদের কল্পনারও অতীত। এত কিছুর পরও সুশীল সমাজের কেউ কেউ বলবে, আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। আপনারা কেন তাদের দিকে এমন কুনজরে দেখেন? তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই কেউ দুধের ধোঁয়া তুলসী পাতা নয়।

বিপরীত লিঙ্গের প্রতি মানবমনের আকর্ষণ খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয় [৯]। চুম্বকের এক টুকরো যেভাবে অন্য টুকরোকে আকর্ষণ করে ঠিক সেরকম। এই নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে উদ্ভূত ফিতনাকে রুখে দিতে ইসলাম পরিপূর্ণ পর্দার বিধানকে কঠোরভাবে মেনে চলার হুকুম দিয়েছে। নারী পুরুষের এই অবাধ মেলামেশার ফলে হায়া বা লজ্জার বিলুপ্তি সাধন হয়েছে। ফলে অশ্লীলতাকেও তারা স্বাভাবিক মনে করতে শুরু করেছে। ফলাফল হিসেবে ধীরে ধীরে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। যেমনঃ রুম ডেট, লিভিং টুগেদার ইত্যাদি। অবাধ মেলামেশার দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি হচ্ছে, নারী আসক্তি থেকে বিকৃত যৌন ক্রিয়ার দিকে ধাবিত হওয়া। এই বক্তব্যের প্রত্যক্ষ উদাহরণ বর্তমানের পাশ্চাত্য সভ্যতা। সেখানে প্রথমে অশ্লীলতার প্রসার ঘটেছে, তারপর নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা, সর্বশেষ বিকৃত যৌন ক্রিয়া। বিশ্বাস না হলে মিলিয়ে নিন।

আজকের সুশীল সমাজের কেউ যদি বলে সে নারী বিক্রয় কর্মীর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেনা, তাহলে সে নেহাত গাল-গপ্পো করছে নতুবা নিজের ঐকান্তিক লিপ্সাকে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ক্ষুধায় জর্জরিত হওয়া সত্যেও লজ্জায় না খেতে চাওয়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কিন্তু শেষে দেখা যায় তিন প্লেট তেহরি একাই মেরে দিয়ে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। কেননা একজন নারী যখন পর্দার বিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মুখে আটা ময়দা মেখে টিশার্ট পরিহিত অবস্থায় সৌন্দর্যের ফেরি করবে তখন ফিতনায় আসক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সুশীলরা সেটা অস্বীকার করে, তারা তো এই কারণেই সুশীল।

আবার যখন নারী স্বাধীনতার নামে এই নারীরাই বিজ্ঞাপনের মডেল হয় তখন ভুলে যেতে হয় পণ্যটা আসলে কি না কে? শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই নিদারুণ সত্য। এ যুগের বিজ্ঞাপন যেন অশ্লীলতার বাজারজাতকরণের অভিনব পন্থা। এভাবে তারা এক এক জন আজ অশ্লীলতার ফেরিওয়ালা বনে গিয়েছে, আর অশ্লীলতাকে নিয়ে গিয়েছে শিল্পের পর্যায়ে। নিজেদের পণ্য হিসেবে উপস্থাপন আজ পশ্চিমা নীতি নৈতিকতার বিচারে তাদের কাছে স্বাভাবিক, শুধু স্বাভাবিকই নয় অধিকারও বটে। মা এবং স্ত্রী হিসেবে প্রাপ্ত সম্মান তাদের কাছে পরাধীনতার শেকল। পণ্য হিসেবে নারীদের উপস্থাপন কোন দৃষ্টিকোণ থেকে সম্মানের সেটা অন্তত আমার বোধগম্য নয়।

অন্যদিকে নারী অধিকারের জন্য প্রতিষ্ঠিত নারীবাদী সংগঠনের নেত্রীদেরও এ নিয়ে কোন মাথা ব্যথাই নেই। আজিব সংগঠন ভাই, এই সংগঠনের নেত্রীদের কাছে নারীদের পণ্য হিসেবে উপস্থাপনটা খুবই স্বাভাবিক, শুধু স্বাভাবিকই নয় গর্বের বিষয়। আজ তারা পুরুষদের সাথে সমানে সমান টক্কর দিচ্ছে এমনকি বিজ্ঞাপনসহ অনেক দিক থেকে বহুলাংশে এগিয়েও আছে। এত বিশাল অর্জনে গর্ব তো হবেই। মাঝে মাঝে এই নারীবাদী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম দেখে তাদেরকে পশ্চিমাদের এজেন্ট মনে হয়। কারণ হিসেবে বলা যায়, তাদের বিবেচিত নারী অধিকার চেতনা। নতুবা পণ্য হিসেবে নারীদের উপস্থাপনের মত ঘৃণ্য কাজকে নারীবাদীরা কোন চেতনার বিশেষ শেকলে আবদ্ধ থেকে গর্বের বলে মনে করে সেটাই প্রশ্নবিদ্ধ। তবে এটা অন্তত বোঝা উচিৎ যে বৃক্ষের গোঁড়ায় গলদ সে বৃক্ষ থেকে ভালো ফলন আশা করা বোকামি।

[সাত]
পাশ্চাত্যের প্রচার করা মোডারেট চিন্তা ভাবনার বদৌলতে আজকের যুব সমাজের অনেকেই পর্দার বিধানকে মনে করে বাড়াবাড়ি। আরও মনে করে এই পরিপূর্ণ পর্দা হচ্ছে সেকেলে একটি কুসংস্কার। তৎকালীন সময়ে নারীদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পুরুষ তান্ত্রিক সমাজ পর্দা প্রথার নামে নারীদেরকে গৃহবন্দী করে রাখত। গৃহ থেকে বের হলেও তারা পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারত না। কিন্তু তারা অনেকেই জানেনা, এটা আল্লাহ প্রদত্ত হুকুম। আর আল্লাহর হুকুম কখনও কুসংস্কার হতে পারে না। আল্লাহর হুকুম অস্বীকার করা কুফরির শামিল। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, “হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিন নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু” [১০]। একটি বিষয় কোন ক্রমেই আমার মজ্জাগত হয় না, নারী কি সৌন্দর্য প্রদর্শনের বস্তু? সৌন্দর্য প্রদর্শন কীভাবে তার অধিকার হতে পারে? আসলে পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণে সবই সম্ভব।

সমাজের দুষ্ট চক্ষুর লোলুপ দৃষ্টি থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেক বোন নিজেদের ইচ্ছায় ইসলামের এই বিধান তথা পরিপূর্ণ পর্দাকে কঠোরভাবে আঁকরে ধরেছে। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন প্রকার অনুশোচনা তাদের নেই, বরং তারা এটা নিয়ে গর্বিত। কারণ তারা আল্লাহর দেয়া বিধানকে পরিপূর্ণভাবে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পেরেছে। যেটা কতটা তৃপ্তির সেটা সেই বোন ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। কিন্তু তারপরও সমাজের কিছু সুশীল এই বোনদের নিয়ে কটূক্তি করে। আমি বুঝতে পারিনা, তারা নারী স্বাধীনতার কথা বলে তবে কেন তারা পরিপূর্ণ পর্দাকে নারী স্বাধীনতার বহির্ভূত মনে করে? সত্যি কথা হচ্ছে, তাদের যত মতবাদ আছে সেগুলো কেবলমাত্র তাদের জন্যেই প্রযোজ্য, মুসলিমদের জন্য নয়। পশ্চিমাদের প্রচলিত প্রত্যেকটি মতবাদই এমন ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এবং ইসলাম বিদ্বেষীতার বহিঃপ্রকাশ।

আজ আমাদের সমাজের নারীদের বিশাল একটি অংশ এই পর্দা নিয়েও লিবারাল তথা উদারনৈতিক হয়ে গিয়েছে। আমরা আজ পরিপূর্ণ পর্দা থেকে বের হয়ে আধুনিক হিজাবের পেঁচে আটকে গিয়েছি। পরিপূর্ণ পর্দা এমন একটা বিষয় যেটা নিয়ে অতীতে আলাদা করে মুখ ঢাকার কথা বলারই প্রয়োজন ছিল না [১১]। আর পর্দার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, সৌন্দর্যকে পরপুরুষের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা। কেউ কি বলতে পারবেন, নারীর চেহারা সৌন্দর্যের বাইরের অংশ? বরং চেহারাই হচ্ছে সৌন্দর্য প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম, যার দরুন মানুষ একে অন্যের প্রতি আসক্ত হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতার সবচেয়ে বড় অর্জন গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নারী স্বাধীনতার নামে মুসলিম নারীর মুখের কাপড় খুলে নেয়া। ক্ষেত্র বিশেষে বক্ষদেশের কাপড়ও খুলে নিয়েছে। আবার অনেক দেশেই আইন করে পরিপূর্ণ পর্দাকে নিষিদ্ধ এবং নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে।

পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণে বর্তমান প্রজন্মের নারীদের বিশাল একটি অংশের পর্দা বিমুখতা আজ চরম পর্যায়ে। শুধু তাই নয় রাস্তাঘাটে তারা এমন ভাবে চলাফেরা করে যেন তারা চায় পরপুরুষ তাদের দেখুক, তাদের নিয়ে মন্তব্য করুক। তারা নিজের খেয়ে অন্যের গুণ গাইতে পছন্দ করে না কিন্তু সৌন্দর্য দেখাতে তাদের কোন আপত্তি নেই। এর বাইরে পর্দার নামেই অনেকে ভয়াবহ রকমের ফিতনার প্রসার ঘটাচ্ছে। বর্তমানে এমন সব বোরখা কিছু বোন পরিধান করে যা তার সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখার পরিবর্তে প্রকাশিত করে। রঙ বেরঙের হিজাবে অনেকেই নিজের সৌন্দর্যকে জাহির করতে অলিখিত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে আমাদের অনেক বোন আজ ভুলতে বসেছে পর্দার মূল উদ্দেশ্য।

[আট]
সুশীল সমাজ আজ যুবকদের তোঁতা পাখির মত Tribalism তথা জাতিগত ভেদাভেদহীনতার বুলি শেখায়, দেখায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন। পাশ্চাত্যের দালালরা আজ আন্ত ধর্মীয় সম্প্রীতির নামে “সকল ধর্মই সমান, সকল ধর্মই সত্য”এমন কুফরি বুলিগুলিও গেলানোর চেষ্টা করছে। সকল ধর্মের মানুষকে সম্মান দেয়া এক ব্যাপার কিন্তু সকল ধর্ম সমান এবং সত্যের বলে মেনে নেয়া প্রকাশ্য কুফরি। আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) সকল ধর্মের মানুষকে নিজে সম্মান করেছেন। তাদের সাথে ব্যবসায়, বন্ধুত্ব, উঠাবসা এমনকি দাওয়াত পর্যন্ত গ্রহণ করেছেন। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। তাই বলে সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে মেনে নেয়ার মত কুফরি তো করা সমীচীন নয়। আজকে পাশ্চাত্যের দোসররা ভিন্ন মতাদর্শদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার নামে প্রকাশ্য কাফেরদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার পায়তারা করছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, শিয়া এবং কাদিয়ানীসহ অন্যান্য কাফের গোষ্ঠীর কথা।

বর্তমানে সুশীলদের প্রচারিত অসাম্প্রদায়িকতার বুলিতে সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই সুশীলরাই পৃথিবীর বুকে এমন একটি রাষ্ট্র দেখাতে পারবেনা যেটা অসাম্প্রদায়িক। তারপরও তাদের এই ভুল মতবাদ প্রচার এবং প্রসারের কোন ঘাটতি নেই। তারা এটা বুঝতে চায়না একটি রাষ্ট্র কখনই অসাম্প্রদায়িক হতে পারে না। একটি দেশে দুই ধরনের মানুষের বসবাস। তাদের মধ্যে একদল হচ্ছে সংখ্যালঘিষ্ঠ অন্যদল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কোন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার অথবা কোন ব্যক্তি এই দুই শ্রেণির মানুষের মধ্যে একটির পক্ষে অবস্থান নেয়া মানে অন্যটির বিপক্ষে অবস্থান নেয়া। আর এখানেই সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হয়। এই সাম্প্রদায়িকতা অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও বহাল তবিয়তেই থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলে বোঝা যায় অসাম্প্রদায়িকতার দাবীটিই অমূলক। যার কোন বাস্তবিক ভিত্তিই নেই।

অন্যদিকে মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে প্রিয়জনদের প্রতি আলাদা রকম মায়ার টান অনুভব করা। যেমনটা আমি আপনি আমাদের পরিবারের প্রতি অনুভব করি। মানবমন আপনজন অথবা প্রিয়জন চিহ্নিত করে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে। উদাহরণ হিসবে বলা যেতে পারে আত্মীয়তার সম্পর্ক, ধর্মীয় বিশ্বাস, দেশ অথবা অঞ্চল এবং সর্বশেষ পশ্চিমে চলমান শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গের ভিত্তিতে। একজন মানুষ প্রিয়জনকে রক্ষার জন্য অপরিচিত একজনের মতের বিপরীতে অবস্থান নিবে, প্রয়োজনে তার সাথে বিবাদে জড়াবে এটাই স্বাভাবিক। সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক চেতনা শুধু চেতনাতেই সম্ভব বাস্তবে নয়।

পাশ্চাত্য সভ্যতার সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে মুসলিমদের চিন্তা ভাবনাকে ভৌগলিক অবস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। যার ফলে উম্মাহর সাথে যতই খারাপ কিছু হোক সেটা নিয়ে আমাদের বিশেষ কিছুই করার থাকে না। তাছাড়া যারা মোডারেট চিন্তা চেতনা লালন করে তাদের কাছে ভৌগলিক সীমানার বাইরে কোন জগত আছে কিনা সেটা নিয়েও একটি প্রশ্ন রয়েই যায়। আর যদি থেকেও থাকে সেটা শুধু খেলাধুলা, সিনেমা চর্চার অথবা অন্যকিছুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ উম্মাহর খাতিরে নয়। কারণ ভৌগলিক অবস্থানের বাইরে মুসলিম উম্মাহর উপর নেমে আসা নির্মম অত্যাচার নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তারা দেখেও যেন দেখেনা। আজকের অনুকরণপ্রিয় যুবসম্প্রদায় পাশের দেশের হাতি নিয়ে মাতামাতি করতে পারে, Justice for Elephant এবং Rest in Peace (RIP) জাতীয় কথাবার্তা উদয় হয় তাদেরই কিবোর্ড থেকে কিন্তু Justice for Ummah আজ তাদের কাছে বাড়াবাড়ি। উম্মাহর উপর চলমান নির্মম নির্যাতন তাদের মনকে সামান্যতম নাড়া দেয় না। এমন কঠিন অত্যাচারে তাদের চক্ষু অশ্রুসজলও হয়না। তারা ধরেই নিয়েছে নিজের ভূখণ্ডে যার যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। ভৌগলিক সীমারেখার মাধ্যমে উম্মাহর মধ্যে বিভাজন তৈরি করে দেয়াই পাশ্চাত্যের সবচেয়ে বড় অর্জন, আর উম্মাহর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। সত্যি বলতে মুসলিম দেশ বলে কিছুই থাকা উচিৎ নয়, যেটা থাকা উচিৎ সেটা হচ্ছে শুধুমাত্র উম্মাতে মুহাম্মাদ (সাঃ)।

উম্মাহর সামান্যতম অপরিনামদর্শিতার ফলে কি পরিমান মাশুল দিতে হতে পারে? যদিও উম্মাহ কি পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে সেটা কল্পনারও অতীত তারপরও আগামী পর্বে সেটার একটি পর্যালোচনা এবং এই ক্রান্তিলগ্ন থেকে উত্তরণে আমাদের করণীয় কি হতে পারে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।

রেফারেন্স সমূহঃ
[১] Research of RAND Corporation on Moderate Muslim (বিস্তারিত তথ্য ১১ নম্বর রেফারেন্স প্রদান করা হয়েছে)
[২] বাংলাদেশের সংবিধান, অনুচ্ছেদঃ ৭(১)
[৩] বাংলাদেশের সংবিধান, অনুচ্ছেদঃ ৮(১) এবং ১২
[৪] পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার অভিযোগঃ তথ্য ফাঁসের দায়ে দুদক কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত, বিবিসি নিউজ, ১০ জুন ২০১৯
[৫] Shoot the Traitors, Discrimination Against Muslims under India’s New Citizenship Policy, Human Rights Watch, 9th April 2020
[৬] Article 23, The Universal Declaration of Human Rights, UN Official Website
[৭] Article 18, The Universal Declaration of Human Rights, UN Official Website
[৮] কালের কণ্ঠ, ৮ই মার্চ, ২০২০
[৯] Here’s Why We Feel Attracted to Opposite Gender, News18, 28th January 2018
[১০] সূরা আহযাবঃ ৫৯
[১১] বইঃ ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে, (৬১,৬২,৬৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)

শতাব্দীর নিকৃষ্টতম ফিতনা ও তরুণ প্রজন্ম
সাবেক কিংকর্তব্যবিমূঢ়

No comments:

Post a Comment