Thursday, April 22, 2021

মাসনা-সুলাসা-রুবায়া ভাবনা

 May be an image of text that says 'মাসনা-সুলাসা-রুবায়া মাসনা- রুবায়া ~জাফর বিপি'

 

আমার মাসনা-সুলাসা-রুবায়া ভাবনা:
মাসনা বিষয়ক কিছু লিখতে ও কমেন্ট করতে ভয় হয়। কারণ, অনেকেই না বুঝে এলেমেলো মন্তব্য করে ইসলামের একটি অকাট্য বিধানকে অবজ্ঞার কারণে নিজের ঈমানকে ধ্বংস করে বসে। আবার অনেকে কথার এপিঠ-ওপিঠ না বুঝে যা-তা মন্তব্য করে বসে।
বিষয়টি নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের এই যে সাপে-নেউলে অবস্থা, এর বলি হতে হচ্ছে অজস্র নিরীহ ও বঞ্চিত ভাই-বোনকে। ২০/২৫/৩০ বা তদূর্ধ্ব বয়সের মেয়ে অবিবাহিত রয়ে গেছে কিংবা বিধবা/ডিভোর্সি হওয়ায় শুধু জাহান্নামের ভয়ে আত্মহনন থেকে বিরত আছে এমন বোনের অভাব নেই সমাজে।
.
আপনি বিশ্বাস করুন আর না করুন, চল্লিশোর্ধ্ব অবিবাহিত কোনো বোনের আর্তনাদও যখন কানে আসে, তখন আসলে এই সমাজকে প্রবোধ দেয়া ছাড়া আর কিছু ভেবে পাই না। আমার মায়ের বয়স তার। ভাবতে পারেন? এমন অনেক আছে। মানসিক অসুস্থতার কারণে চিকিৎসা নিয়ে যাচ্ছেন। একপর্যায়ে ট্রিটমেন্ট এর জন্য সাজেশন জানতে চাইলে তথ্যটি জানতে পারি।
আমার নিজের দেখা, সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সবদিক থেকে সক্ষম একজন ব্যক্তি তার তীব্র প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র সামাজিক কারণে মাসনা করতে পারছে না। একবার সবকিছু মাড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু সমাজের নিকট হেরে গেলেন...
.
আমি মানছি, সমতা রক্ষায় সবাই সফল হয় না। কারণ শতভাগ সমতা রক্ষা করা মূলত আমাদের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু তাই বলে কি আমরা মানুষের সাথে লেনদেন ছেড়ে দিয়েছি? কথা বলা ছেড়ে দিয়েছি? আমাদের নিত্যকার চলন-বলনে ও আত্মীয়তার সম্পর্কে কি আমরা শতভাগ ন্যায় ও সত্যকে গ্রহণ করতে পেরেছি? পারিনি। অথচ সবই চলছে।
পাশাপাশি উন্নতির চেষ্টা করছি। আলিমরা নাসিহা করছেন। আমরা শুনছি। আমলের চেষ্টা করছি। ভুল করে ফেললে তাওবাহ করছি। আবার চেষ্টা করছি। কিন্তু শতভাগ বিশুদ্ধভাবে মুয়ামালাত-মুয়াশারাত চালাতে পারব না বলে কিন্তু এসব বন্ধ করে দিইনি। তবে মাসনা-সুলাসা-রুবায়া এই আমলটা কেন বন্ধ করে দিয়েছি? কেন আমরা শতভাগ বিশুদ্ধ হয়ে এরপর এটা করতে হবে মর্মে ধারণা পোষণ করছি? এটা কি আদৌও সম্ভব?
.
সূরা নিসার ৩নং আয়াতের দলিলে যারা সমতার কথা বলে এক বিয়ে পর্যন্তই ক্ষ্যান্ত দিতে বলে, সেই একই আয়াতে দুই-তিন অথবা চারটি বিয়ের অনুমতি আল্লাহ তায়ালাই দিয়ে রেখেছেন। এবং একই সূরার ১২৯ নং আয়াতে সমতার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা এটাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, তবে তোমরা এটা (সমতা রক্ষা) কখনোই পারবে না। আরও জানিয়েছেন, কেউ যদি সর্বাত্মক চেষ্টা করে ও চেষ্টা সত্ত্বেও নানা ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয়, আল্লাহ তায়ালাকে সে ক্ষমাশীল হিসেবে পাবে।
দেখুন:
“তোমরা কখনও স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার করতে পারবে না, যদিও তোমরা তা কামনা করো। তবে তোমরা কোন একজনের দিকে সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়ো না এবং অপরকে ঝুলন্ত অবস্থায় ছেড়ে দিয়ো না। আর যদি তোমরা নিজেদের সংশোধন কর ও সংযমী হও, তবে নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা নিসা: ১২৯]
যারা এই আয়াতের প্রথম অংশ—“তোমরা কখনও স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার করতে পারবে না, যদিও তোমরা তা কামনা করো।” দেখিয়ে বলে যে, যেহেতু সমতা রক্ষা করা সম্ভব না, তাই ইসলাম মাসনা-সুলাসা-রুবায়ায় নিরুৎসাহিত করেছেন, তারা আয়াতের প্রথম অংশটুকু পড়েই ক্ষ্যান্ত হয়ে যায়। শেষাংশটুকু আর বুঝতে চায় না।
শেষাংশে:
“আর যদি তোমরা নিজেদের সংশোধন কর ও সংযমী হও, তবে নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
এই অংশের ব্যাখ্যায় তাফসির ইবনে কাসীরে এসেছে—যতদূর তােমাদের সাধ্যের মধ্যে রয়েছে, তােমাদের স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায় ও সমতা রক্ষা করো, এরপর যদি কোন সময় কারো প্রতি বেইনসাফি করে ফেলো এবং নিজেদের কাজের সংশােধন করে নাও, সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করে চলো, তাহলে তিনি তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন। [তাফসির ইবনে কাসীর: পৃষ্ঠা ৪৯৩]
.
তাহলে সামর্থ ও সক্ষমতা থাকলে হিম্মত করতে সমস্যাটা কোথায়? আমাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে এভাবেই কি অপরাপর অসহায় বোনগুলো নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করবে? এভাবেই কি আমাদের ভাইয়েরা পরকীয়া আর যিনা-ব্যাভিচারের গহীন অরণ্যে হারিয়ে যাবে? আর ইনসাফ করতে না পারার জুজুর ভয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে?
হ্যাঁ, একজনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অন্যজনকে ঝুলন্ত অবস্থায় ফেলে রাখায় অনেক বোন নানা বৈষম্য ও নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। হচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা এটা উক্ত আয়াতে সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন। এবং এমন ব্যক্তি কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় উঠবে যে, তার শরীরের অর্ধেক অংশের গোস্ত খসে পড়বে। [আবু দাঊদ: ৩২২]
ইসলামের এই আদর্শকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর কারণেই একাধীক বিয়েকে সমাজ এভাবে দেখছে। কেউ দ্বিতীয় বিয়ে করলেই তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। আর এই সুযোগে ‘পরকিয়া’ নামক সমাজবিধ্বংসী ভাইরাস মহামারির রূপ নিয়েছে।
.
আমরা যারা একাধিক বিয়ে শুনলেই গর্জে উঠি, সেই আমরা যদি পরকিয়া কিংবা যিনা-ব্যাভিচার রোধে এভাবে গর্জে উঠতে পারতাম, তাহলে কতই না উত্তম হতো! অথচ আল্লাহ তায়ালা পরকীয়া ও যিনা-ব্যাভিচারকে হারাম করেছেন, আর দুই-তিন অথবা চার বিয়েকে হালাল করেছেন।
অনেকে আবার মাসনার অর্থ এই মনে করে যে, মাসনা করতে হলে একদম অসহায় ও দুস্থ কাউকেই করতে হবে। পছন্দসই কাউকে গ্রহণ করলে সেখানেও দুশ্চরিত্র তকমা! কেন রে বাবা! ইসলামই তো এই সুযোগ দিয়েছে যে, যাকে তোমার পছন্দ হয় তাকে বিয়ে করো। দুই-তিন অথবা চার! [সূরা নিসা: ৩]
.
এক্ষেত্রে আল্লাহর দেয়া এই অধিকারকে অবমাননা করার আমরা কে? কেউ তার পছন্দমতো করতে আগ্রহী হলে তাকে কটাক্ষপাত করে বলা—“মাসনা করতে সুন্দরী, কচি, কুমারী লাগবে কেন? করতে হলে ডিভোর্সি ও বিধবাকে করুন।” এসব শব্দ প্রয়োগে বিদ্বেষ উগড়ে দেয়ার সাহস ও অধিকার আমাদের কে দিলো?
হ্যাঁ, আমরা এটা বলতে পারি—যাদের চাহিদা নিয়ন্ত্রিত ও যারা অধিক পূণ্যের আশা করে, তাদের জন্য এক্ষেত্রে কোনো অসহায়-বিপদগ্রস্তকে গ্রহণ করা উত্তম ও অনেক নেকীর কাজ। এভাবে বললে আশাকরি সবাই বিষয়টিকে খুবই পজিটিভলি নেবেন। যাদের সামর্থ আছে, আর চাহিদাও সীমিত, তারা এই সুযোগটি খুব সহজেই গ্রহণ করতে উদ্যোগী হবে। আগ্রহী হবে।
.
আর যারা চাহিদার কারণে ও প্রয়োজনের তাকিদে দুই-তিন-চার পর্যন্ত ছুঁতে চায়, তাদেরকে তাদের রবের দেয়া স্বাধীনতার ওপর ছেড়ে দিন। ফোর্স করবেন না। কাউকে ইনসাল্ট করবেন না। আল্লাহর দেয়া স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে অনধিকার চর্চা করবেন না। এতে সে বিপথে যাবে। সম্মানের ভয়ে ব্যাভিচার থেকে বেঁচে থাকলেও শয়তানের ধোকায় পড়ে নীল অন্তর্জালে ফেঁসে যাবে। চারিত্রিক ও নৈতিক পদস্খলন হবে। কোনোভাবেই ফেরাতে পারবেন না। সম্ভব না।
যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন, তাকে এই চাহিদা তিনিই দিয়েছেন, এবং তা পূরণে দুই-তিন-চার পর্যন্ত অনুমতিও দিয়েছেন। এটা ন্যাচারাল। এই ন্যাচারল প্রোসেসকে বাধাগ্রস্ত করলে সামাজিক অবক্ষয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।
.
এই বিষয় নিয়ে কিছু বললেই অনেকে নিজের বোন-ভাগ্নি-ভাতিজি ওদের কাউকে মাসনা হিসবে দেয়া-নেয়ার ব্যাপার নিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকের চেষ্টা করে৷ আরে বাবা! কেউ সত্য ও সঠিক জ্ঞান প্রচার করলো বলে সেটা তার মাঝে থাকতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা কে দিলো? যার বোন-ভাগ্নি-ভাতিজি কেউ নেই তাহলে তাকে কী বলবেন? যার আছে, সেখানে যদি তেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে আশাকরি সে সেটা ওখানেও মেনে নেবে। এজন্য পার্সনাল অ্যাটাক না করলেও চলবে। সে যদি নিজের ক্ষেত্রে আল্লাহর এই বিধানের কোনো অবমাননা করে তাহলে সে-ও সমানভাবে গুনাহগার হবে, যেমনভাবে আজ আপনি এর বিরোধিতা করে হচ্ছেন।
আল্লাহর আইন সকলের জন্য সমান। এটা কোনো মানুষের তৈরি আইন নয় যে, শাসকের জন্য একরকম, শাসিতের জন্য ভিন্নরকম। এটা আল্লাহর আইন। নিঃসন্দেহে তিনি মহা ন্যায়বিচারক। কাজেই, এটা নিয়ে আপনার কাউন্টার অ্যাটাকের প্রয়োজন নেই। দুই কাধে কিরামান-কাতিবিন এজন্য প্রস্তুত আছেন।
.
সমাজে এই একটি বিষয় কঠিন হওয়ার সাইডইফেক্ট কী জঘন্য ও করুণ তা কল্পনাও করতে পারবেন না। সামাজ ও স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করে, তাদের নিকট নানা বিচিত্র রিপোর্ট অহরহ আসছে। আমার প্রোফেশন ও প্যাসন এই ফিল্ডের হওয়ায় আমি নিজেও এমন অসংখ্য কেইসের সাক্ষী।
আমাদের আসলে চোখের সামনে দিয়ে সুঁই গেলেও সহ্য হয় না। কিন্তু পেছন থেকে কামান দাগালেও কষ্ট হয় না। সমস্যাটা এখানে।
.
প্রথম বিয়ের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। এখানে স্বাবলম্বী হওয়া, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, পরিবারের ওপর নির্ভরশীল না থাকা ইত্যাদি সহ নানা ব্যাপার থাকে। সবমিলিয়ে এই ব্যাপারটাও খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা ভিন্ন আলাপ।
এবার নোয়াখালীর এক চাচার গল্প শুল্প শুনুন:
প্রায় ৪ বছর আগে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ সফরে গিয়েছিলাম। সেখানে এক চাচা তার দুই পরিবার ও দুই পরিবারের সন্তান নিয়ে একই বাড়িতে ভিন্ন ভিন্ন ঘর তুলে থাকছেন। বেশ সুখেই তাদের জীবন কাটছে।
গিয়েছিলাম তার বাসায়। সুযোগ পেয়ে কিছুক্ষণ খোশালাপেও মজেছিলাম। আমি যেহেতু তার সন্তানের বয়সী ছিলাম, এবং অবিবাহিত ছিলাম, তাই বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি। তার ছেলের কাছ থেকে অনেককিছু শুনেছিলাম। তার দুই পরিবারের সন্তানদের মাঝেও বেশ সাবলীল সম্পর্ক দেখে সত্যিই অভিভূত হয়েছিলাম। দোয়া করি তার জন্য। এবং আরও দোয়া করি, যারা দুই-তিন-চারের স্বপ্ন দেখে, সাপোর্ট দেয় ও সাহস করে তাদের জন্য।
এবার দুজন বোনের মন্তব্য শুনুন:
১.
“মাসনায় স্বামীকে সাহায্য করা উম্মুল মু'মীনিনদের আদর্শ। স্বামীর চরিত্র রক্ষার্থে বোনেরা এগিয়ে আসুন। শুধু এইটুকু বলেছিলাম। এটা নিয়ে বোনেরা আমার উপর চরম ক্ষ্যাপা।
অথচ মাসনা না করে ৮/১০ জন মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করলেও আমার বোনেদের তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু হালালভাবে কাউকে গ্রহণ করলেই জাত গেলো জাত গেলো বলে সমাজকে মাথায় তুলে বোনেরা।”
২.
“আমি এখনো মিসকিন আলহামদুলিল্লাহ। হযরত আয়েশা রা. কুমারী হয়েও তো বিয়ে বসেছিলেন রাসুলুল্লাহ সা. এর সাথে। তাও তার আরও স্ত্রী আছে জেনেই! তাহলে আমি আর কে?
তাই মাসনার বিষয়ে আমার কোন আপত্তি নেই এবং যদি আমার অর্ধেক দ্বীন বউদের হক আদায় করতে পারে তাহলে কিসের আপত্তি!
এটা তো তখন আমার জন্য আরও ভালো হবে যে, আমি একটু ইবাদতের জন্য বেশি সময় পাব। সাথে তার অন্যান্য স্ত্রীদেরও বোন হিসেবে পেয়ে যাব। আহ কী আনন্দ!”
আমি তাদের মন্তব্য শুনে বিস্মিত হয়েছি। এমন বিশুদ্ধ মানসিকতা আমাদের নারীদের মাঝে খুবই পজিটিভ। এতে করে সমাজ থেকে নানা পাপাচার ও অশ্লিলতার দাফন হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
তবে অধিকাংশ নারী সত্ত্বার নিকট বিষয়টি কষ্টের। এটা নারীর ফিতরাত। স্বাভাবিক ব্যাপার। নিজের ভালোবাসার ভাগ কেউ দিতে চায় না। কিন্তু উপরের দুটি মন্তব্য হলো মহীয়সী দ্বীনদার নারীর ফিতরাত। যারা নিজের ভালো লাগা ও মন্দ লাগার ওপর আল্লাহর বিধানকে সন্তুষ্ট চিত্তে প্রাধান্য দিতে পারে, মেনে নিতে পারে। তারা সত্যিই মহীয়সী।
উদাহরণ_স্বরূপ:
কেউ শহীদের স্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখে, আবার কেউ স্বামীকে আঁচলে গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখতে পছন্দ করে।
অর্থাৎ কেউ তার প্রাণাধিক প্রিয় মানুষটিকে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতেও রাজি। দ্বীনকে সে তার ইচ্ছা ও ভালো লাগার ওপর সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছে। আর অন্যজন নিজের পার্থিব কষ্টের শঙ্কায় স্বামীকে নানা ভয় দেখিয়ে কাপুরুষ বানিয়ে কুক্ষিগত করে রাখছে—এরা উভয়ে কি সমান হতে পারে?
তেমনি মাসনা-সুলাসা-রুবায়া নামক দ্বীনের একটি বিধান ও আল্লাহর পক্ষ থেকে হালাল করা একটি বিষয় কেউ আল্লাহর জন্য অবলিলায় মেনে নিতে পারে। নিজের ইচ্ছার ওপর প্রাধান্য দিতে পারে। আর কেউ এমনটা মুখে আনলেই যুদ্ধ বাধিয়ে ফেলে—এরা উভয়ে কি সমান হতে পারে?
.
তবে মানবিক দৃষ্টিতে এতে ব্যথিত হওয়া নারীর সহজাত প্রবৃত্তি কিংবা ফিতরাত। স্বাভাবিক। এটা হতেই পারে। বরং কমবেশি হবেই। কিন্তু কোনো হালাল বিষয়কে মন্দ জানা ও তার বিরোধিতা করা নিঃসন্দেহে বদ্বীনি।
.
মাসনা-সুলাসা-রুবায়া অর্থাৎ দুই-তিন কিংবা চারটি পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণ করা আল্লাহ কর্তৃক একটি অনুমোদিত বিষয়। সম্পূর্ণ হালাল বিষয়। কিন্তু জরুরি না। তাই এ নিয়ে বাড়াবাড়ি কাম্য নয়। আবার কেউ এতে আগ্রহী হলে তাতে বাধা দেয়ার অধিকারও কারো নেই। এবং ব্যক্তি বিশেষের ত্রুটির কারণে এই বিধানকে অবজ্ঞা করে বা হেয় প্রতিপন্ন করে অশালীন মন্তব্য করার অধিকারও কারো নেই। এগুলো ঈমানের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
.
তবে আমাদের সমাজে বিষয়টি নেগেটিভলি নেয়ার পেছনে মূলত নারী-পুরুষ উভয়েই দায়ী।
পুরুষের_দোষ: তাদের অনেকেই দ্বিতীয় বিয়ের পর প্রথমা বা পূর্বের স্ত্রীর প্রতি জুলুম করে বসে। পূর্বের সন্তানদের বঞ্চিত করে। এটা জঘন্য অপরাধ। আখিরাতে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে এদের। এই বিষয়টির কারণেই আজ সমাজের মানুষ মাসনাকে আড়চোখে দেখে। আর সুলাসা-রুবায়া তো আকাশকুসুম! কাজেই, এরা শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই অপরাধ করেনি, সামগ্রিক অবক্ষয়ের জন্যও এরা প্রকাশ্যভাবে দায়ী। দেশের আইনেও এদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
.
তাই মাসনা-সুলাসা-রুবায়া এর চিন্তা করার আগে এই বিষয়গুলো নিয়ে নিজের সাথে একটা বোঝাপড়া করুন। শারিরীক, আর্থিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে নিজেকে ন্যূনতম সক্ষম করে তুলুন। এরপরই মাসনা-সুলাসা-রুবায়া এর কথা ভাবুন। এটাকে ফ্যান্টাসি ভাববেন না। আজ ফ্যান্টাসি ভাবলে কাল বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আর দায়িত্বকে দায়িত্ব হিসেবে নিলে এটা নিয়ামত হিসেবে দাঁড়াবে।
কারণ বিয়ে মানেই দায়িত্ব। আর দায়িত্ব মানেই চাপ। এগুলো বহন করার জন্য প্রস্তুতি না থাকলে আপনার জন্য মাসনা-সুলাসা-রুবায়া জায়েজ নেই।
[বিয়ের প্রকৃত স্বরূপ, দায়িত্ব-কর্তব্য ও দাম্পত্যের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব সমস্যার সমাধান জানতে লাভ_ক্যান্ডি ও রিমেডি বই দুটি পড়তে পারেন।]
.
তবে হিম্মত হারাবেন না। আল্লাহর ওপর ভরসা করে নিজেকে তৈরি করুন। সাহস করুন। আর পদক্ষেপ নিন। আল্লাহ সাহায্য করবেন। এবং দায়িত্বশীল হতে পারলে টুকটাক ভুলত্রুটি আল্লাহ ক্ষমাও করে দেবেন। নবী-রাসুল ব্যতীত শতভাগ সমতা রক্ষা করতে বাস্তবিকই কেউ পারেনি, আর পারবেও না। তাই আশাহত না হয়ে চেষ্টা করুন। সাহস করুন। সমাজের নৈতিক অবক্ষয় রোধে সাধ্যানুযায়ী সচেষ্ট হোন। আল্লাহ ভরসা।
.
নারীর_দোষ: তারা একে অপরকে সহ্য করতে পারে না। কোনো স্বামী সমতা রক্ষা করতে চাইলেও তারা একে অন্যের প্রতি হিংসা পোষণ করে স্বামীর সমতা বিধানকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। এটা প্রথমা ও দ্বিতীয়া উভয়ের দোষ। এদিক থেকে নারীরা নিজেরাই নিজেদের শত্রু।
.
প্রথমার_বিশেষ_দোষ: স্বামীর নতুন স্ত্রীর প্রতি একটু বেশি ঝুঁকে পড়াটা পুরুষের ফিতরাত। স্বাভাবিক। কিন্তু স্ত্রী এটা বোঝে না। অহেতুক মনঃকষ্টে ভোগে। ডিপ্রেশনে ভোগে। হীনমন্যতায় ভোগে।
এমতাবস্থায় তার উচিত হলো, স্বামীর প্রতি আরও অধিক আন্তরিক ও অনুগত হওয়া। অধিক মমতা ও ভালোবাসা দেখানো। টেক-কেয়ার বাড়িয়ে দেয়া। এবং নতুন স্ত্রীর প্রতি বোনসূলভ আচরণ করা। সম্ভব হলে তার ভালোমন্দও খেয়াল রাখা। এতে স্বামী আপনার প্রতি বিমুখ হবে না। এবং নতুন স্ত্রীও আপনাকে শত্রু ভাববে না। বড়বোন হিসেবে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে।
এবং নতুনের প্রতি মোহ কেটে গেলে ‘Old is Gold’ ভাবনা তার মনে গেঁথে যাবে। তার সাব-কনশাস মাইন্ড আপনাকে সবসময় মিস করবে। এভাবে আপনি তার নিকট অমূল্য হয়ে উঠবেন।
.
কিন্তু এটা না করে তারা কথায় ও আচরণে নানাভাবে স্বামীকে কষ্ট দেয়। চরিত্র নিয়ে আকারে-ইঙ্গিতে লজ্জা দেয়। কিছু হলেই নতুনের কথা তুলে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়। এতে তার সাব-কনশাস মাইন্ড অটোমেটিক নতুনের প্রতি আরও বেশি ঝুঁকে পড়ে। এবং অনেকসময় প্রথমার এই আচরণের কারণে তার প্রতি বিরক্ত বোধ করেন।
ঠিক এই মুহূর্তটির সুযোগ নেয় শয়তান। এতে স্বামী নিজের অজান্তেই প্রথমা ও তার সন্তানের প্রতি জুলুম শুরু করে বসে। খোঁজ নিতে চায় না। ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে।
শারয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে স্বামীর ওপর প্রত্যেক স্ত্রীরই সমান অধিকার। এখানে প্রথমা অধিক জোর খাটানোর চেষ্টা করে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনে। একটু বোঝার চেষ্টা না করে আবেগ ও রাগকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের চতুর্মুখী বিপদ ডেকে আনে।
.
মাসনার_বিশেষ_দোষ: প্রথমাকে সম্মান করে না। স্বামীকে পেয়ে একদম একাই কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। প্রথমার সন্তান কিংবা তার কোনোকিছুকে সহ্য করতে পারে না। প্রথমাকে নিজের বড় বোন না ভেবে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। এতেকরে প্রথমার মন স্বচ্ছ থাকলেও ধীরেধীরে সে নিজেও হিংসা শুরু করে। শুরু হয়ে যায় এক চরম গৃহযুদ্ধ।
অথচ রাসূল সা. এর বিবিগন, সাহাবাদের বিবিগন তারা ফিতরাতগতভাবে সাময়িক কষ্ট পেলেও আল্লাহর বিধানকে মেনে নিতেন। নিজের অপর বোনদের হক নষ্ট করে নিজে একাই সুখী হতে চাইতেন না।
.
কতই না সুন্দর দৃশ্য—একজন স্বামী তার ওয়াহেদা, মাসনা, সুলাসা ও রুবায়া নিয়ে সবাই সম্মিলিতভাবে দ্বীনচর্চা করে, ইলম চর্চা করে, একে অন্যের সাথে সুসম্পর্ক রাখে, একইসাথে হালাল উপার্জনের জন্য সচেষ্ট থাকে এবং অধিক সন্তানের মাধ্যমে দ্বীনের জন্য নিবেদিত আলিম, দাঈ ও মুজাহিদ তৈরির স্বপ্ন দেখে। মুসলিম ইতিহাসের স্বর্ণযুগের চিত্র কিন্তু এমনই ছিল।
আর বর্তমানে বিবাহ কঠিন ও মাসনা-সুলাসা-রুবায়াকে মহা কঠিন করে তোলায় সমাজ পরকীয়া ও যিনা-ব্যাভিচারে ছয়লাব হয়ে গেছে। অনুমোদিত যৌনপল্লী তৈরি হয়েছে। কিংবা সম্মতির ভিক্তিতে অনেকেই ফ্ল্যাটমুখী হচ্ছে। আর সম্মতি না মিললেই বনেবাদাড়ে লাশ ও পত্রিকার পাতায় বিভৎস সব নিউজ দেখতে হচ্ছে। বিধ্বস্ত হচ্ছে সমাজব্যবস্থা। আর বিলুপ্ত হচ্ছে নৈতিক চরিত্র।
অথচ আল্লাহ তায়ালা বিবাহ সহজ করে আর মাসনা-সুলাসা-রুবায়া হালাল করে আমাদের আলো দান করেছিলেন। আমরা সেই আলোর পথ রুদ্ধ করে অন্ধকার ডেকে এনেছি। সমাজিক এই বিপর্যয় তো আমাদের প্রাপ্য ছিল, তাই না?
.
আমারা প্রত্যেকেই যদি অন্যের ত্রুটিগুলো নিয়ে অ্যাটাক-কাউন্টার অ্যাটাক না করে নিজেদের ত্রুটিগুলো সংশোধন করে নিই, তাহলে আমাদের সমাজ থেকে এই বিশৃঙ্খল পরিবেশ দ্রুতই পরিবর্তন হবে, ইনশাআল্লাহ। অতঃপর সমাজের অবিবাহিত, ডিভোর্সি ও বিধবা বোনগুলোর চোখে আনন্দাশ্রু সোভা পাবে। অবলা মেয়েগুলো বেঁচে থাকার নতুন অবলম্বন খুঁজে পাবে। আর পুরুষ নিজের চরিত্রকে পবিত্র রাখতে সক্ষম হবে। এবং সমাজ পরকীয়া ও যিনা-ব্যাভিচারের মতো অনাচার থেকে রেহাই পবে।
সর্বপরি লক্ষ রাখতে হবে—আমাদের ভালো লাগা কিংবা মন্দ লাগা যেন আল্লাহর বিধানের অনুগত হয়। এবং আমাদের আবেগ, আর চাওয়া-পাওয়ার ভিড়ে আল্লাহর বিধান যেন লাঞ্চিত ও অবহেলিত না হয়।
আল্লাহ তাওফিক দাতা।
~জাফর বিপি

 

 

 

 

 

No comments:

Post a Comment